Tuesday, February 14, 2012

ঊষার দুয়ারে

১.




হানিফ সাহেবের ডান পায়ের গোড়ালিটা সামান্য বেরিয়েছিল। এত সামান্য যে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত পাগলা স্বাধীন ছাড়া কারো নজরে পড়ে নাই। আবাহনী মাঠে পশ্চিম মাঠের ডান পাশে দেয়াল ঘেঁষে যে নেট প্র্যাক্টিসের সিমেন্ট পীচ তার থেকে আরো খানিক উত্তরে আগাছার ঝোপে পড়েছিলেন ভদ্রলোক। আটটা থেকে সোয়া আটটা নাগাদ হানিফ সাহেবের বাড়ির লোক, পুলিশ আর ডাক্তার এসে মুখটুখ ঢেকে নিয়ে গেলেন ধানমণ্ডি থানায়। মাথায় আঘাত করা হয়েছে। শরিরে আর কোথাও আঘাতের কোন চিহ্ন নাই। আবাহনী ক্লাবের দেয়াল ঘেঁষে মজনু মিয়ার চায়ের দোকান, পূর্ব মাঠের গ্রাউণ্ডসম্যানসহ ঐ মুহুর্তে যে কয়জনকে মাঠে পাওয়া গেল সবাইকে একদফা জেরা করে ধানমণ্ডি থানার ওসি সোয়া দশটা নাগাদ বিদায় হলেন। জাতীয় লীগের খেলা শুরু হবার কথা পূর্ব মাঠে সাড়ে নয়টায়। পাক্কা একঘন্টা লেইট।




২.




পুলিশের সন্দেহ হানিফ সাহেবের ছোট মেয়ে ফুলকি'র জামাই রুবেলই এই কর্ম করেছে। গত বৃহ:স্পতিবার দুপুরে মোহাম্মদপুর কাজী অফিসে কাবিন সেরে সন্ধ্যায় ভাইয়ের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে রাতে ফুলকিদের বাড়ি থেকেও অর্ধচন্দ্র পায় নবদম্পতি। হানিফ সাহেব নাকি একটা আধলা ইটও ছুঁড়েছিলেন বখাটে জামাইকে। আজ দুপুরে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কমিশনারের শালার বাসা থেকে রুবেল গ্রেফতার হয়েছে। কমিশনারের শালার বাসার দারোয়ানের ভাষ্যমতে রুবেল ভোরবেলায় বেরিয়ে বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ফিরেছে। হানিফ সাহেব রোজকার মতন প্রাত:ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। রুবেল এলাকায় বাজে ছেলে বলে পরিচিত। তবে সুপুরুষ হওয়ায় বালিকামহলের অনেকেরই ড্রিমবয়।




৩.




সন্দেহের তীর এবার মতিন-মুসা ফাউণ্ডেশানের দিকে। বছর খানেক আগে এই ডেভেলপারদের নজর পড়ে  হানিফ সাহেবের পৈত্রিক বাড়িতে। দরদাম পছন্দ না হওয়ায় ভদ্রলোক রাজী হন নাই। কিন্তু মতিন-মুসা ফাউণ্ডেশান আর ঝুলোঝুলি ছাড়ে না। তারপর প্রচলিত নিয়মে গুণ্ডা লাগানো হয়। সপ্তাহে অন্তত একবার করে হুমকির ফোন আসতে থাকে। অবশ্যই আপস প্রস্তাবসহ। হানিফ সাহেব দ্বারস্থ হন অ্যান্টি-গ্রুপের মাস্তানদের। তারপর সপ্তাহ দু্‌ই আগে কমিশনারের বাসায় দুইপক্ষে আপসরফার চেষ্টা অমিমাংসিতভাবে শেষ হলেও একরকম যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এখানে নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করছে শুক্রবারের ফোনটা। রুবেল বলছে সে ঐ ফোন করে নাই। ঐ সময় সে বাসার খোঁজে বেরিয়েছিল। মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লায়  যেই বাসা দেখতে গিয়েছিল তার বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পুলিশ রুবেলকে ছেড়ে দেয়।




৪.




সন্দেহের কাঁটা আরো ঘোরে। এবার হানিফ সাহেবের প্রথম পক্ষের পুত্র। প্রথমা স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ১৯৬৮ সালে হানিফ সাহেব তাকে তালাক দেন। ১৯৬৯ সালে জন্মানো পুত্রকেও অস্বীকার করেন। ১৯৭৯ সালে সেই পুত্রসহ প্রথমা স্ত্রী এসে সন্তানের পিতৃপরিচয় দাবী করলে পাড়াপড়শীর চাপে হানিফ সাহেব মেনে নেন। পুত্রের স্কুলের কাগজপত্রে  হানিফ সাহেবেরই নাম থাকে।ঐ আমলে ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থা ছিল না। সেই ছেলে অবশ্য শেষ পর্যন্ত লেখা পড়া ইন্টারমিডিয়েটের বেশী আগাতে পারে নাই। ১৯৯০ এর পরে পুরোপুরি বখে যায়। হানিফ সাহেবের দ্বিতীয় পক্ষের জেষ্ঠ্য পুত্র মারফত জানা যায় সম্প্রতি তিনি উকিলের সাথে আলাপ করছিলেন। কোনভাবে সেটা জানতে পেরে ঐ ছেলে প্রায়ই হানিফ সাহেবকে ফলো করতো। নজর রাখতে নিয়োগ করা গোটা তিন বখাটেকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। বাপের মৃত্যুর দিন থেকে ছেলে পলাতক। উকিলের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় উইলের ব্যাপারেই আলোচনা চলছিল তবে সেটা তখনও ফাইনাল হয় নাই। সম্ভাব্য ওয়ারিশদের তালিকায় প্রথমপক্ষের পুত্র বাদ।




৫.




খেলাটেলা না থাকলে আবাহনী মাঠের পূর্ব গ্যালারীর ডান দিকের কোনায় দুপুর বেলায় গাছের ছায়ায় জমিয়ে ঘুমানো যায়। কীভাবে যেন হানিফ সাহেবের কেসটাই ভাবছিলাম। একে ক্রনিক বেকার। তারউপর চারদিকে একটা কথা সবাই বলতে থাকলে মাথার মধ্যে ঢুকে যায়। ১৯৮৯তে শারমীন রীমা বা ১৯৯০ এ তাজুলের মতো। তিন সপ্তাহ ধরে মিডিয়া আর চলমান গুজবের কল্যাণে মাঠের পাবলিক গ্যাজানোর আর কোন বিষয় পায় নাই। আমি চুপচাপ শুনে গেছি। অস্বস্তি আছে বেশ কিছু। সেগুলি এখনো বলি নাই কাউকে। আমার ধারণা এখন পর্যন্ত যারা যারা সন্দেহের তালিকায় আছে তারা কেউই হানিফ সাহেবের খুনি না। তাদের খুব কাছাকাছিরই অন্য কেউ কাজটা করেছে। কিন্তু পাঁচেচারে নয় করতে পারছি না।

: কইলজা! ঐ কইলজা হালার পো ওঠ! ঐ চুতমারানি!

মাওলার চিৎকারে তন্দ্রা ভেঙে গেলো। খুবই বিরক্ত হয়ে উঠে বসলাম।

: খেউকাছ ক্যা মাঙ্গের পো!

মাওলা উঠে আসে গ্যালারীতে।

: মেসে আইলি না যে? মুর্গা পাক করছিলাম ...

: রেশমী আইছিল। তেহারি খাইছি কলাবাগানে..

: মৌজে আছছ চুতমারানি

কথা বলতে ইচছা করে না আর। কাঁচাঘুম ভাঙ্গার বেদনার সাথে কোনকিছুর তুলনা হয় না। চা খেতে পারলে হেভি হতো। কিন্তু কারো প্র্যাক্টিস না থাকলে বিকাল তিনটায় আবাহনী মাঠ মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করে।

: এদিকে ঘটনা শুনছস?

মাওলা একটা স্টার ফিল্টার ধরিয়ে ভক ভক করে ধোঁয়া ছাড়ে।

: কী?

: ঐ যে হানিফা হালার কথা কই। আরো কাহিনি হইছে।

: এইবার কে? প্রথম পক্ষের বৌ?

: প্রায় কাছাইছছ। বৌ, তবে দ্বিতীয় পক্ষ।

: অ ..

: আমি তো শুইনা পুরা টাস্কি খাইলাম

: কৈত্তে শুনলি?

: মজনুর দোকানে। এগারোটার দিকে ঠোলা আইসা কামালরে ধইরা লইয়া গেছে?

: কামালরে ...? ক্যান?

: ও থাকে পশ্চিম গ্যালারীর তলে

: তা জানি কিন্তু অরে ধরলো ক্যান? ও তো কইছিল ঐদিন ভোরে মধুবাজার আছিল

: মিছা কথা কইছে.. ঐদিন সে গ্যালারীর নিচেই ঘুমাইছিল.. ভোরে নাকি দেখছে কারা জানি হানিফারে পাও ধইরা টাইনা ঝোপের দিকে নিতাছে ...

: মারতে তো আর দ্যাখে নাই..

: ঐটা আর বাকি থাকে নাকি.. দেইখা সোজা গেছেগা মধুবাজার

: কয়টার সময়?

: পোনে ছয়টার দিকে তো কয় ..

: যারা টানতেছিল তাগো চিনে নাই?

: না তো কয়..

: তাইলে আর অগ্রগতি কীয়ের? এরপরের ঘটনা তো সবাই জানে। কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষের নাম আইলো কেমনে?

: ঐখানেই তো কাহিনি .... আগে চা খাওয়া তারপর কমু..

: খাওয়ামু কিন্তু তুই আগে ক...

: আগে চা পরে বাতচিৎ

: হাউয়ার নাতি ....




৬.




হানিফ সাহেবের বিষয় সম্পত্তি মাশাল্লা ভালোই। ছিল রায়ের বাজারে সাদামাটা চাউলের ব্যাপারি। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় হিন্দুদের জায়গাজমি দখল করে এলাকার গণমান্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়। তার প্রথম স্ত্রী কনভার্টেড মুসলিম। অবশ্য ধর্মান্তরের কোন রেকর্ড পাওয়া যায় নাই। দাঙ্গার সময় পালবাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। তখন সে রায়ের বাজার হাইস্কুলের পাশে টালি অফিস রোডে থাকতো। তারপর বৌয়ের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ এবং ডিভোর্স। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে চলে যায় এবং ১৯৭২ সালে ফিরে এসে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। বাড়ি করে দূর্গা মন্দিরের গলিতে। '৭৩ সালে বিয়ে করে বর্তমান স্ত্রী সখিনা বানুকে। এই ঘরে পাঁচ ছেলে মেয়ে। দুই ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে বাপের ব্যবসায় দেখে। ব্যবসায় মানে বাজারে চাউলের দোকান আর চারটা বাড়ির ষোলঘর ভাড়াটিয়া থেকে ভাড়া আদায়। ছোট ছেলে রায়ের বাজার হাইস্কুলে ভূগোল পড়ায়। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে শরীফ ঘরে। ছোট মেয়েটা পালিয়ে বিয়ে করেছে খুনের চারদিন আগে।




ঘটনা হচ্ছে  হানিফ সাহেব কিছুদিন আগ থেকে যে উইল করার ধান্দা করছিলেন সেই বিষয়ে অন্দরমহলে অশান্তি চলছিল। সেই প্রথম পক্ষের ছেলেকে স্বীকৃতি দেবার সময় থেকে সখিনা বানুর মনে ভয় ছিল পিতৃপরিচয় যখন একবার পেয়ে গেছে এরপর সম্পত্তির ভাগও একদিন না একদিন চেয়ে বসবে। এই বিষয়ে হানিফ সাহেবকে সে বেশ কয়েকবার কসমটসম খাওয়ানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু ভদ্রলোক নির্বিকার থাকায় অশান্তি বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ছোটমেয়েটা বখাটে রুবেলকে বিয়ে করে বসায় পরিস্থিতি চরমে ওঠে। প্রতিবেশীদের ভাষ্যমতে হানিফ সাহেব নাকি শেষ কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায়ই সবাইকে পাছায় লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন। সখিনা বানু বড় ছেলের মাধ্যমে কমিশনার গ্রুপের ছেলেপেলেদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন ভদ্রলোককে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে। কমিশনার গ্রুপের খসরু আজ সকালে পুলিশের কাছে এইসব বলার পরে পুলিশ হানিফ সাহেবের বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। মাওলা দুপুরে খাওয়ার পরে সেইখানেই ছিল ঘন্টাখানেক।

: তারপর সোজা মাঠে আইছি ..

: আর আইসা আমার কাঁচা ঘুমের পুটকিটা মারছৎ..তারপরে বাল আবার চা'ও খাইছৎ আমার পয়সায়..

: আমি আরো দুইটা পুরি খামু..

 মাওলা উঠে দোকানের দিকে গিয়ে পুরি আর সালাদ নিয়ে আসে।

আমার উশখুশ কাটেনা।

: কিন্তু কমিশনার গ্রুপের পোলা স্বীকারোক্তিতে কী কইছে?

: খুনের কথা কয় নাই। কইছে যে ম্যাডাম তাগো লগে আলাপ করছে বুইড়ারে কতল করা বিষয়ে..খুন কারা করছে অরা জানে না...এরপরে ঠোলা আইসা কামালরে ধরছে...আর ঐগ্রুপের বাকি পোলাপান হাওয়া ... কমিশনার ঠোলারে সর্বোচ্য সহয়তার প্রতিশ্রুতি দিছে ইত্যাদি ...

: কিন্তু ভোরবেলা কাগো দেখছে সেইটা কামাল জানে না। তারমানে ঘটনা সেই আন্ধারেই থাকতেছে।

: বাইরাইবো সবই ... যেই ডিটেকটিভ অফিসার এইসব বাইর করছে সে নাকি বহুত ঘাগু লোক...এর আগে কই কই জানি কী কী করছে ...

: বাইর হইলেই ভালো।




৭.




বিকালের রোদ পড়ে আসছে। খুনের ঘটনার পর থেকে পশ্চিম মাঠের কোনার ঐ সিমেন্ট পীচে ছেলেপেলেরা আর খেলছে না। ঐ দিকেই কেউ যায় না পারতপক্ষে। মাওলার কাছ থেকে ধার করা স্টার ফিল্টার টানতে টানতে ঝোপের দিকে আগাই। কিছু কাঁটা গাছ এখনো ভেঙে বাঁকা হয়ে আছে। ঘষটানোর দাগ ছিল না। কারণ যেখান দিয়ে ঘষটানোর কথা বলা হচ্ছে সেখানে ঘাস ঘন। আর ভদ্রলোককে সম্ভবত চ্যাংদোলা করে ঝোপের আড়ালে ফেলা হয়েছিল। পীচের উপর এসে দাঁড়াই। কত যে খেলেছি একসময় এইখানে তার ইয়ত্তা নাই। আবাহনী ক্লাবের দিক থেকে বোলিং হতো। ঝোপের দিকে ব্যাটিং।অন সাইডে লপটেড শট খেলা যেতো না। অনের দিকে দেয়াল পার হলেই রাস্তা। পশ্চিম মাঠের দেয়াল ঘেঁষে আসতে থাকি মজুন মিয়ার দোকানের দিকে। আজ আর বসবো না। সামনের গেট দিয়ে বের হয়ে মেসে ফিরবো।




৮.


খেলোয়াড় হবার স্বপ্ন বাদ দিয়েছি বাংলাদেশ আইসিসি চ্যাম্পিয়ান হবার পাঁচ বছর আগে। তবে পোলাপানদের সাথে খেলা ছাড়ি নাই। পূর্ব,পশ্চিম যে দিকেই হোক কোথাও কোন গ্রুপে খেলোয়াড় কম পড়লেই ঢুকে পড়ি। কখনও খেলা বাদ দিয়ে আম্পায়ারিং করি। ঝগড়াঝাটি হলে পোলাপান হাতের কাছে পেয়ে আমাকেই সলিশ মানে। কোনরকমে টিকে থাকার একটা ব্যবস্থা করতে পারলে বেকার জীবনটা তেমন খারাপ কিছু না।

পশ্চিম গ্যালারীর সামনে আজকে যাদের দেখা যাচ্ছে তারা প্রায় সবাই শঙ্কর আর উনিশ নম্বর এলাকার। বয়স সীমা বারো থেকে পনের। একজনকে শুধু আগে দেখি নাই। হাতে দারুণ সব শট। আমি বা মাওলা যখন ওদের বয়সে ছিলাম তখন বা-হাতি ব্যাটসম্যান কদাচিৎ দেখা যেতো। এখন প্রায় সমান সমান। ছেলেটার নাম ভোলানাথ পাল। পুলপাড়ের বিশ্বনাথ পালের ছেলে। বিশ‌্বনাথবাবুকে চেহারায় চিনতাম। ভদ্রলোকের একটা ওষুধের দোকান ছিল। ভোলানাথের আরেক ভাইকেও দেখলাম। সোমনাথ পাল। সে অবশ্য ডানহাতি। আর খেলাও চোখে পড়ার মত না। তবে দুই জনই খু্‌ব ফিট। ভিষন স্পোর্টিং। ওরা আগে ফিজিক্যাল কলেজের মাঠে খেলতো। সম্প্রতি বিশ্বনাথবাবু শঙ্করে ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেইসূত্রে তার পুত্রদের খেলার মাঠও বদলে গেছে।


৯.

কয়েকদিন পরের কোন এক শনিবার। জাতীয় লীগের কোন একটা খেলার তিন দিনের দিন বেলা তিনটার মধ্যে কেউ ইনিংস ডিফিট খেয়ে খেলা শেষ। সোমনাথ ভোলানাথ দুই ভাইই বিজয়ী দলের সমর্থক হিসাবে খুব উত্তেজিত। আমার ধারণা উত্তেজনার আসল কারণ বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে ফার্স্টক্লাস ক্রিকেট দেখতে পাওয়া। আজকে কারো নেট প্র্যাকটিস নাই। পূর্ব গ্যালারীর সামনের সিমেন্ট পীচেই টুকটাক নকিং শুরু করলাম। খেলা শেষ হবার পরে মাঠ প্রায় খালি। বিশেষ করে পূবদিকে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নাই। ভোলানাথ আমার একটা ইয়র্কার লেন্থের বলকে ফুলটস নিয়ে একেবারে মানিক মিঞার বাড়ির কাছাকাছি পাঠিয়ে দিলো। বল নিয়ে ফিরতে ফিরতে দেখি ওদের গ্রুপের আরো পোলাপান আসতে শুরু করেছে। মাওলাকেও দেখা গেলো কামালের কাছ থেকে সিগারেট কিনতে। কামাল গত পরশু ছাড়া পেয়েছে।

১০.

হাজতের অভিজ্ঞতা শুনলাম কামালের কাছে। খুব ভয়ে ছিল কয়েকদিন। পরে কমিশনার নিজে নাকি ওকে ভরসা দিয়েছে। আর পুলিশও টানা কয়েকদিন জেরা করে নিশ্চিত হয়েছে ঐ লাশ টেনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া সে আর কিছু দেখে নাই। এমন কি ঐ দেহটা হানিফ সাহেবের কিনা সেটাও সে হলফ করে বলতে পারে না। সখিনা বানু গ্রেফতার হয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পরে এলাকার মানুষও মোটামুটি নিশ্চিন্ত। মজনু মিয়ার দোকানে নিয়মিত আড্ডাবাজরাও নিশ্চিত যে আল্লাহই হানিফ মিয়াকে সম্পত্তি দখলের পাপের শাস্তি দিয়েছেন এবং বাংলার ঘরে ঘরে এখনো কতশত ঘষেটি বেগম রয়ে গেছে ইত্যাদি।

একটা মাটি কামড়ানো শট মাওলার পায়ের কাছে চলে এসেছিলো। মাওলা ডিরেক্ট খ্রো করে সোজা বোলারকে ফিরিয়ে দিল। ওর হাতে থ্রো বরাবরই খুব ভালো।

উঠে পড়লাম। অনেকদিন পরে দুই বন্ধু কলাবাগানে যাচ্ছি হালিম খেতে। মাওলার ডিরেক্ট থ্রোতে ফিরিয়ে দেওয়া ঐ বলটাই লেগেছিল হানিফ সাহেবের মাথায়। উনিশ নাম্বারে আসার পর থেকে ভোলানাথ আর সোমনাথ প্রতিদিন ভোরে জগিং আর নকিং করতে মাঠে আসে। হানিফ সাহেবও আসতেন টুকটাক জগিং আর ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়াম করতে। ভোলানাথ হুক করেছিল সোমনাথের একটা শর্টপীচ। হানিফ সাহেব ছিলেন ফাইন লেগ বরাবর। বল মাথায় লাগতে লুটিয়ে পড়েন। দুইভাই ভয় পেয়ে জিনিসপত্র গুটিয়ে সাড়ে পাঁচটার দিকে বাড়ি ফিরে যায়। সখিনা বানুর পাঠানো গুণ্ডারা এসে হানিফ সাহেবের অচেতন দেহটাকে পেয়ে ঝোপের আড়ালে ফেলে আসে। অক্টোবর মাসে সাড়ে পাঁচটায় ফরসা হতে শুরু করলেও মাঠে প্রাত:ভ্রমণকারীদের ভিড় হতে হতে ছয়টা পেরিয়ে যায়। সূর্যের আলো সম্পূর্ন পরিস্কার হবার বেশ কিছুক্ষণ পরে ঝোপের কাছে প্রস্রাব করতে গিয়ে পাগলা স্বাধীন হানিফ সাহেবের দেহটা আবিস্কার করে।

সোমনাথ-ভোলানাথরা ভবিষ্যতে ক্রিকেটার হতে চায়। এই দূর্ঘটনার স্মৃতি ওদের মাথা থেকে হারিয়ে যাক। জীবনের বৈচিত্র্যে কইলজা আর মাওলার মতো ভবঘুরে বেকাররাই চমৎকৃত হোক। সাকার মানুষের অত সময় কোথায়?

No comments: