Friday, January 03, 2014

প্রভু, পৃথিবীতে তোমার লীলা অবিরাম

৫ জানুয়ারীর নির্বাচন হচ্ছেই। সমঝোতা হবে না এটা সেপ্টেম্বরে সুপ্রীম কোর্টে কসাই কাদেরের রায়ের পরেই বোঝা গেছে। কিন্তু সেটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে প্রধান বিরোধিদল বি.এন.পি'র সমঝোতা। কারণ বি.এন.পি. নামের দলটা এখন যুদ্ধাপরাধী জামাতের পেটে। কিন্তু অতি সমঝদার বামপন্থী দলগুলির সমঝে ঠিক কী আছে সেটা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এসে আরো ধোঁয়াটে হয়ে গেল। তাঁরাও দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেন। তাঁরাও কি কারো পেটে? নাকি তাঁরা এমন কোন গূঢ় অভিসন্দর্ভ রচনা করছেন যার ভাষা বুঝতে আমি অপারগ?
ঠাণ্ডা লড়াই যূগের কথা ছেড়ে দিলাম। বুঝলাম তখন কেবলাই সবকিছুর নির্ধারক। নইলে আক্কেল দাঁতওয়ালা বুদ্ধিতে চীনপন্থীদের দুই কুকুরের লড়াইয়ের এবং সোভিয়েতপন্থীদের ১৯৭৩ সালের ত্রিদলীয় জোট আর বাকশালে যোগ দেবার কারণ বোঝা অসম্ভব। ১৯৮৯-'৯১এ প্রথমে পূর্ব ইউরোপ পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট/সোশালিস্ট/ওয়ার্কার্স/লেবার পার্টিগুলির একদলীয় শাসনের অবসান হবার পরে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের মতো বাংলাদেশের বামপন্থীদলগুলিও কেবলা-বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বিশেষ করে সোভিয়েতপন্থী সি.পি.বি.। সমাজতন্ত্র, সর্বহারার আন্তর্জাতিকতা ইত্যাদির উপর বীতশ্রুদ্ধ হয়ে সি.পি.বি. থেকে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় সাবেক কমরেডরা রূপান্তরিত কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণফোরাম, আওয়ামী লীগ এমনকি বি.এন.পিতেও চলে গেলেন। তারপরেও পার্টি ধ্বংস হলো না। কিছু লোকে অন্তত চোখের সামনে পাঁচহাত না দেখাতেই হলো না। ১৯৯৪তে অবশেষে বামফ্রন্টের জন্ম হওয়ায় একধরণের ঐক্যের প্রবণতা দেখা দিল। সেইসময়ে তাঁরা সীমিত লোকবল নিয়েও ১৯৯৬ এর ১২ জুনের নির্বাচনে নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছিলেন। সেই ঘোরতর ডানপন্থী হাওয়ার যূগে বামফ্রন্টের টিকেটে নির্বাচনের মাঠে দাঁড়ানোর কঠিণ কাজটা তাঁরা করেছিলেন। এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলের মাঝামাঝি তাঁরা আবারো ঐক্যের প্রশ্নে বামের বদলে ডানে গিয়ে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের সাথে ১১ দলীয় জোট করলেন। বাম ঐক্যের সম্ভাবনা দীর্ঘ সময়ের জন্য পাতালে গেল। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় এলে ১১ দল যখন আওয়ামী লীগ আর কার কার সাথে যেন মিলে ১৪ দলীয় জোট করলেন তখন সিপিবি সেই জোট থেকে বেরিয়ে এসে একলা চলার নীতিগ্রহণ করলে তাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসাবেই দেখেছিলাম। কারণ এর আগে একেবারে ১৯৫৬ থেকে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে বর্জুয়াদলের লেজুড়বৃত্তির ধারাবাহিকতা চলছিল। এরপর বিএনপি আমল থেকে একেবারে এবারের আওয়ামী লীগ আমলের মাঝামঝি পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে সিপিবি'র মধ্যে বামঐক্য সমুন্নত রেখে সক্রিয় থাকার ইতিবাচক প্রবণতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। গণতান্ত্রিক বামমোর্চা নামে একাট বামজোটও গড়ে উঠল। ভাবলাম ঐক্য ক্রমে আসিতেছে। ২০১১'র শেষার্ধে এসে তেলগ্যাস-প্রকৃতিক সম্পদরক্ষা আন্দোলনে কী যেন একটা হলো। দলগুলি ক্রমশ নিজেদের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে বিনা প্রয়োজনে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করে দিলো। তারপর একময় সিপিবি-বাসদ, বামমোর্চা থেকে বেরিয়ে গেল। তেলগ্যাস আন্দোলন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে রহস্যজনকভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো। অথচ বামঐক্য ছাড়া যে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় পথে নামবার দায় আর কারো নেই সেটা একটা ছাগুও বোঝে। একই ঘটনা লক্ষ্য করলাম একের পর এক পোশাক কারখানায় আগুন দিয়ে শ্রমিক হত্যার ইস্যুতেও। এই ইস্যুগুলি একতরফাভাবেই বামইস্যু। যদি বামদলগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমিকদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে ইস্যুগুলি সাম্রাজ্যবাদের দালাল এন.জি.ও.গুলি খেয়ে ফেলবে এতো সহজ কথা সবকিছু সবাত্তে বেশি বোঝা বামপন্থীদের বিশেষত সিপিবি'র না বুঝবার কথা নয়। কিন্তু হলো না। তাজরীনে দেড়শ শ্রমিক পুড়ে মরলো, রাণা প্লাজা ধ্বসে দু হাজার শ্রমিক নিহত হলেন কিছুতেই শ্রমিক শ্রেণী ঐক্যবদ্ধভাবে বামপন্থীদের পাশে পেলেন না।
সিপিবি-বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি-বাসদ-গণসংহতি-জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সবাই সবার থেকে বেশি বোঝেন। এতো বেশি বোঝেন যে দুয়েদুয়ে চার করার মতো সহজ গণিত থেকে অতি সতর্কতার সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন। আমি দুই দশক ধরে নির্বোধের মতো শুধু দেখেই যাচ্ছি। বামফ্রন্ট কেন ১৯৯৯ সালে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, জাতীয় গণফ্রন্টের সাথে ঐক্যের দিকে না গিয়ে গণফোরামের দিকে গেল, কেনই বা গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট ২০০০ সালে অক্টোবরে ভেঙ্গে গেল, কেন ২০০১ সালে সিপিবি-ওয়ার্কার্স পার্টি জোড়া লাগতে গিয়েও লাগলো না, গণতান্ত্রিক বামোমোর্চা থেকে সিপিবি-বাসদ কেন ২০১২ সালে বেরিয়ে গেল, কেন সবচাইতে জরুরি মুহুর্তে এসে তেলগ্যাস আন্দোলন থমকে গেল এর কিছুই বুঝলাম না। জিজ্ঞাসা করলে কী কী যেন বলে তারপর হঠাৎ আওয়ামী লীগকে গালাগালি শুরু করে। অথচ অন্তত আমি কখনোই আওয়ামী লীগের সাথে বাম দলের ঐক্যের বা আওয়ামী লীগকে বাম দলগুলির সমর্থনের কথা বলি নাই। আমার সহজ সরল বুদ্ধিতে শুধু বামঐক্যের প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝি। ঠিক সেই প্রশ্নটার কোন সোজাসুজি উত্তর তারা ব্লগে-ফেইসবুকে কখনো দেন না।
এই সমস্ত না বোঝা প্রশ্নগুলিকে ছাপিয়ে গেল গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার প্রশ্ন। বিএনপি-জামাত কেন যাবে না আমরা জানি। তাঁদের আন্দোলন জমছে না কারণ ১৯৯৫-'৯৬তে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের হাতে জনগণকে নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীতা প্রমাণের জন্য মাগুরা উপনির্বাচনের দৃষ্টান্ত ছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অন্য অনেকগুলি সিরিয়াস ইস্যু থাকলেও ঐ রকম কারচুপির নির্বাচন করার কোন দৃষ্টান্ত বিএনপির সামনে নেই। কিন্তু তারপরেও নির্বাচনে যেতে তাদের অসুবিধা আছে, কারণ জামাতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে আর দলটা যেকোন মুহুর্তে নিষিদ্ধ হতে পারে। জামাত ছাড়া বিএনপির চলবে না বলে বিএনপির প্রাজ্ঞ নীতি নির্ধারকেরা মনে করেন। সুতরাং জামাতকে বাঁচাতে যে করেই হোক নির্বাচন ঠেকাতে হবে। তাই বিএনপির কথা থাক। বামপন্থীরা নির্বাচনে যাচ্ছেন না কেন? কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা কি তাঁরা দিয়েছেন? অথচ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ঠেকাতেই হোক, দ্বিদলীয় রাজনীতির বিষাক্ত বৃত্ত থেকে মুক্ত হতেই হোক আর ইনসাফ (?) প্রতিষ্ঠা করতেই হোক নির্বাচনের বিকল্প নাই। অন্তত এই মুহুর্তে নাই। সেকথা আবার বামদলগুলি স্বীকারও করেন। তাহলে নির্বাচনে যাচ্ছেন না কেন? আপনারা খুব ভালো করেই জানেন সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হলে স্যাম চাচার কোলে চড়ে মামারা এসে পড়বেন। তখন ইনসাফের গাঢ় ফেটে দরজা হয়ে যাবে। তাহলে কেন যাচ্ছেন না? আপনাদের রাজনৈতিক কর্মসূচী আসলে কী? কেন জনগণ সব ছেড়ে আপনাদের সমর্থন করবেন? আওয়ামীলীগটাওয়ামীলীগ জাহান্নামে যাক, সমর্থকের প্রশ্নের জবাব দিন! দ্বৈপায়ন হ্রদে কী মতলব ডুবিয়ে রেখেছেন কমরেড?

1 comment:

Kafy said...
This comment has been removed by the author.