Tuesday, February 03, 2015

টুকরো টুকরো লেখা ২৭

টানা কয়েকদিন বিরক্তিকর মেঘের পরে আজকে সকাল থেকে টানা রৌদ্র পাচ্ছি। শীতের দিন রৌদ্রজ্জ্বল হলে ঠাণ্ডা বাড়ে। তাতে আমার তেমন সমস্যা নাই। আমার সমস্যা গোমড়ামুখো আকাশ থেকে টিপটিপ বৃষ্টিতে। মগজ আর মাংসপেশী একসাথে বোবা হয়ে যায়। আজ সারাদিনে কয়েকদিন ধরে এখানে ওখানে খাবলা খাবলা জমাটবাঁধা তুষার গলেছে। দুপুরের পর থেকে তাপমাত্রা নেমে যেতে সামনের বাড়িগুলিতে টালির ফাঁকে ফাঁকে চিমটি চিমটি সাদা টিকে গিয়ে পড়ন্ত রোদকে আলাদা মাত্রা দিচ্ছে। শীতকালে এরকমই ভালো লাগে।
১.
জীবনে অনেক আন্দোলন কাছ থেকে দেখছি। আন্দোলন মানে মিছিল, সমাবেশ, পুলিশের সাথে ধাক্কাধাক্কি-মারামরি-ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, জনগণের মধ্য থেকে আন্দোলন সমর্থনকারী বহু মানুষের সরব উপস্থিতি। নাশকতা গত তিনচার দশকের সব আন্দোলনেই কমবেশি ছিল। কিন্তু মিছিল-সমাবেশের সর্বাত্মক অনুপস্থিতিতে একতরফা গণপরিবহণে সাধারণ মানুষের গায়ে অগ্নিসংযোগকে আন্দোলন বলে দাবী করার চল ২০১৩ সালের আগে ছিল কি? আমার মনে পড়ছে না। ২০১৩ সালের নাশকতামূলক "আন্দোলন" ব্যর্থ হওয়ায় ভেবেছিলাম এই তড়িকা স্থায়ীভাবেই বাতিল হলো বুঝি। হলো না। বছর খানেক পরে সেই ফ্লপ তড়িকাতেই আবার শুরু। ২০১৩ সালে তাও ফাঁকেফুকে কিছু মিছিলটিছিল বের হতো। এবার সেসবের বালাই নেই। নেত্রী দলীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছাবন্দি, নেতারা তার আশেপাশে ঘাপটি মেরে বসে আছেন। একের পর এক কর্মসূচীর ঘোষনা আসছে সেখান থেকে। সেইসব কর্মসূচী পালনে কোন পিকেটারকে রাস্তায় দেখা যায় না। নাশকতা যা হচ্ছে তার প্রায় সবই লুম্পেনদের দিয়ে। রাজনৈতিক কর্মীরা রাস্তায় নেই। রাস্তায় না থাকার পেছনে পুলিশি অ্যাকশানকে দায়ী করা খুবই হাস্যকর রাজনৈতিক যুক্তি। এই যুক্তির মানে দাঁড়ায় যে দল এতোটাই শক্তিশালি যে এর কর্মীরা পুলিশের মারের ভয়ে রাস্তায় নামছেন না। বৃটিশ বিরোধি আন্দোলন থেকে আজ পর্যন্ত কোন আন্দোলনে পুলিশ বা সেনাবাহিনি আন্দোলনকারীদের উপর সদয় ছিল এমন তো মনে পড়ছে না। কর্মীরা ঝুঁকি নিতে না চাইলে তার অর্থ একটাই। নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা।
এইভাবে যে আন্দোলনের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না বা দিনের শেষে ভোটে জিতে গদীতে বসাও খুব সহজ হয় না, এটা কি তবে বেগম জিয়া জানেন না? সেরকম তো হবার কথা নয়। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দুইবারের বিরোধি দলীয় নেত্রী, তিনি ৯০'এর গণ অভ্যুত্থানের প্রধান দুই নেত্রীর একজন। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাতেই তাঁর বুঝবার কথা, যে এভাবে হয় না। তারপরেও তিনি টানা হরতাল-অবরোধ দিয়েই যাচ্ছেন। বইমেলা, এসএসসি পরীক্ষা, অর্থনীতির সর্বনাশ কোন কিছুই তাঁর কাছে জরুরি না হোক, অন্তত আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তো পরিস্কার থাকবে! অবস্থাদৃষ্টে সেরকম মনে হচ্ছে না। মিছিল-সমাবেশ-গণসংযোগ বাদে শুধু নাশকতা থাকলে তখন দৃশ্যত: নাশকতাটাকেই উদ্দেশ্য বলে মনে হতে থাকে। তৃতীয় বিশ্বে নাশকতার পরিণতি সবাই যেমন জানে, তিনি তার থেকে কম জানার কোন কারণ নেই। তিনি নিজেও অতীতে সেই পরিণতির ভুক্তভোগী। তাহলে কেন? নিতান্তই ধ্বংসের আগে জিঘাংসা জানিয়ে যাওয়া?
২.
দল হিসেবে বিএনপি জটিল সঙ্কটে আছে এটা ঘটনা। সেই ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর থেকে গত আট বছরে সঙ্কট ক্রমশই জটিল হয়েছে। কিছু সঙ্কট সঙ্গে নিয়ে সব রাজনৈতিক দল যাত্রা শুরু করে। নির্ভরশীল বিশ্বে সামরিক শাসনামলে কিংস পার্টি হিসাবে জন্ম নেওয়া বিএনপির ক্ষেত্রে প্রথম সঙ্কট। এই সঙ্কট মোটামুটি অনতিক্রম্য হলেও পরবর্তী সামরিক স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরে বিএনপি দেশজ পার্টিতে (Volkspartei) পরিণত হবার পথে পা দেয়। ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দুটো নির্বাচন থেকে অনেকেই হয়তো আশা করছিলেন বিএনপি ক্রমশ কিংসপার্টি ইমেজকে ঝেড়ে ফেলে পুরমাত্রায় সংসদীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে আশির দশকের শেষ থেকে নব্বই দশকের শেষে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট আর এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে চার দলীয় জোট গঠণ করার আগ পর্যন্ত সারাদেশের পাবলিক উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠাণে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রবল জনপ্রিয়তা থেকে অনেকেই ভবিষ্যত বিএনপিতে আপাত ইতিবাচক নেতৃত্বকে দেখতে পাচ্ছিলেন।
দুটো ঘটনা এই ইতিবাচক প্রক্রিয়াকে আটকে দেয়। জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট এবং দলীয় রাজনীতিতে তারেক রহমানের আবির্ভাব। এই দুটি ফ্যাক্টার ২০০১ সালে বিপুল বিজয়কে অতিদ্রুত শুধু ক্ষমতা থেকে পতনের পরিবর্তে পুরো দলেরই ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই ধারাবহিকতাতেই আজকের এই মিটিংমিছিলবর্জিত আন্দোলনের পরিণতি। খালেদা জিয়া হয়তো ভাবছেন, শুধু তারেককে কোনমতে বাঁচাতে পারলেই হবে দলের যা হয় হোক। কিন্তু ঘটনাতো দিনের শেষে আর অতটা সরল থাকছে না। দেশের বিভিন্নস্থানে জনগণ ইতোমধ্যেই নাশকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শুরু করে দিয়েছে। এই প্রতিরোধ শক্তিশালী হয়ে উঠলে শুধু ফেরারি আসামী তারেক রহমান না, বেগম জিয়া নিজেও ধ্বংস হবেন। কয়েক দিন ধরে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো তাই চাচ্ছেন।
৩.
বিরোধিদের দাপটে পেগিডা অন্তত রাস্তা থেকে পিছু হঠছে। গত কাল সন্ধ‌্যায় ফ্রাঙ্কফুর্টে পেগিডা বিরোধিদের বিশাল সমাবেশ থেকে সেরকমই মনে হচ্ছে। দিনের শেষে ঝলমলে রৌদ্রের পরে এইটাই স্বস্তি।
এই ধরণের স্বস্তিতে জিমি ক্লিফকে মনে পড়ে

1 comment:

Kafy said...
This comment has been removed by the author.