Tuesday, May 19, 2020

লক ডাউননামা : কদম আলী!

কদম আলী পিৎসা ভালোই বানায়। শুধু পিৎসা না বেশ কয়েক ধরণের ইতালীয় পাস্তাতেও তার হাত পাকা। ফাব্রিৎসিও কাসিয়া রীতিমতো হাতে ধরে ইতালীয় রান্না শিখিয়েছেন। সে অনেক কাল আগের কথা। কদম আলীর তখন জার্মানীতে মোটে মাস ছয়েক।

ঊনিশশ একানব্বই... হ্যাঁ একানব্বইতেই এসেছিল। ভ্রমণ ভিসায় বেলগ্রেড পর্যন্ত। তারপর কীভাবেকীভাবে যেন তখনকার যুগোশ্লাভিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া পেরিয়ে পূর্ব জার্মানীর যাক্সেন প্রদেশে। তারপর পুলিশের সাথে হেসেন প্রদেশের গীসেন শহরে। কয়েক মাস পরে কাসেল।

কদম আলীর গ্রামের শাহ আলম মামা আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে কাসেলে। মোটামুটি অভিজাত একটা ইতালীয় রেস্তোরায় কাজ করতেন। সেখানেই প্রথম কাজ জুটলো কদম আলীর। প্রথম বেশ কিছুদিন খুব ঝামেলা হতো। তাড়াহুড়ায় সব তালগোল পাকিয়ে ফেলতো। পরে দোকানের মালিক ফাব্রিৎসিওর সুনজরে পড়ে কয়েক বছরে ঐ রেস্তোরার যাবতীয় রান্নাবাড়া শিখে ফেলে।

দশ বছর কাজ করেছে ঐ রেস্তোরায়। কিছুদিন পরপরই দেশে টাকা পাঠাতে পারতো। নিজের তেমন কোন খরচ নেই। বেঁচে থাকার ন্যুনতমটা তো সরকারই দেয়। এর বাইরে রেস্তোরার রান্নাঘরে কাজ করে যা আসে তার পুরোটাই সরকারি হিসাবের বাইরে। শাহ আলম মামার পরিচিত কে যেন ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকে, প্রায়ই দেশে যায়, তার মাধ্যমেই কদম আলী বাড়িতে টাকা পাঠায়। কখনো ঝামেলা হয় নাই।

এরপর শাহ আলম মামা নিজেই পিৎসা হোম ডেলিভারির দোকান দিলে সেখানে বছর পাঁচেক রান্নাঘর সামলায় কদম আলী। তারপর মামা একদিন দেশে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল। দোকানটাও আর চললো না।

গত এক যূগ ধরে কদম আলী কখনো এই দোকানে কখনো সেই রেস্তোরায় কখনো সরকারের দেয়া ন্যুনতম বেঁচে থাকার প্রণোদনায় বেঁচে আছে। অর্থাৎ জীবিত আছে। অন্তত প্রোটোপ্লাজম সক্রিয় আছে এরকম বলা যায়।

বড় রেস্তোরায় কাজ আর পাওয়া যাবে না। কর্মদক্ষতার সমর্থনে কাগজপত্র নাই। ফাব্রিৎসিও ইতালি ফিরে গেছে দুইহাজারদুই সালে। মাঝেমধ্যে কর দিতে হবে না এমন আয়ের মিনিজব বাদে আর কোথাও কখনো বৈধ উপার্জনমূলক কাজের চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করতে হয় নাই।

তাতে কদম আলীর উপকারই হয়েছে। বাড়িতে মোটামুটি নিয়মিত টাকা পাঠাতে পেরেছে। বৈধ আয়ের বিপদ অনেক। বৈধ চুক্তিপত্রে গেলেই সরকারি সাহায্য বন্ধ। উল্টা সরকারকে কর দিতে হয়, চিকিৎসা বীমা দিতে হয়, অবসর বীমা দিতে হয়। সব দিয়েথুয়ে নিজেরই কোনরকম টেনটুনে চলতে হয়। আর অত বীমা দিয়ে কদম আলীর কী দরকার? পুরোটাই বাজে খরচ।

বৈধ উপার্জনমূলক কাজের ফাঁদে পা দেয়নি বলেই সব মিলিয়ে প্রায় তিনটা পরিবার বাংলাদেশে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। বাবামা ভাল আছেন। অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাচ্ছেন। ছোট ভাইটার সংসারও চলছে। বড় ভাতিজা এইচএসসি পাশ করেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। অত টাকা কীভাবে কোথা থেকে আসবে এইসব ভাবতে ভাবতেই গত জানুয়ারিতে জার্মানী ফিরেছিল কদম আলী। ছোট ভাইটা মূর্তিমান অপদার্থ। কয়েকবারই বিভিন্ন সৃজনশীল ব্যবসায়ের জন্য বড় ভাইয়ের অতিকষ্টার্জিত অর্থের শ্রাদ্ধ করেছে। এবার একটা মুদির দোকানে বসিয়ে, ভাইকে খুব করে শাসিয়ে এসেছে কদম আলী। যেভাবেই হোক দোকান চালাতে হবে। কালকে কদম আলীর হঠাৎ দম ফুরালে ভাত জুটবে কোত্থেকে?

তাছাড়া আমেনা আছে। ওর মেয়েটারও কী যেন কঠিণ অসুখ। আমেনার স্বামী ছয় বছর আগে ট্রেনে কাটা পড়ে। আমেনার সংসারও কদম আলীর হাতে। কদম আলীর সাথে তার একটা সংসার হতে পারতো হয়তো কিংবা পারতো না। পারে নাই এটাই ঘটনা।

এগুলি কোন সমস্যা না। মানুষের জীবনে আরো অনেক রকম জটিল সমস্যা থাকে।
সমস্যা হলো, সর্বশেষ যে পিৎসার দোকানে কাজ করতো নভেম্বর পর্যন্ত, জানুয়ারিতে এসে দেখে সেখানে তালা। মালিক সপরিবারে ইতালি না অস্ট্রিয়া কোথায় যেন বেড়াতে গেছেন। মোবাইল বন্ধ। বা যে নম্বর কদমের কাছে আছে সেটা বন্ধ।

নিরুপায় হয়ে শামসুভাইকে ধরতে হল। শামসু ভা্‌ইয়ের নিজের একটা মুদি দোকানের মত আছে যার একপাশে বসে বিয়ারটিয়ার খাওয়া যায়। দুইটা আধা লিটারের বিয়ার আর চার শট ভদকা পরিমাণ সময় গভির মনোযোগে কদম আলীর কাহিনি শুনলেন শামসু ভাই।

মহল্লার  বুড়োবুড়িদের অনেকেই আসেন সারাদিন। বিয়ারের সাথে টুকটাক খাবারও পাওয়া যায়। সেখানেই কদম আলী আপাতত কাজে লেগে গেল।

মার্চের ষোল তারিখ হঠাৎ করে দোকানপাট সব বন্ধ। করোনা না কি যেন একটা কী অসুখ ছড়িয়েছে সারা দুনিয়ায় সেটা ঠেকাতে। ষোল তারিখ রাতে সেরকম একটা মজমা হলো শামসু ভাইয়ের বাসায়। টানা খাটুনির পরে শরির বিশ্রাম চাচ্ছিল। লক ডাউনের প্রথম বেশ কয়টা দিন শুয়েবসে কেটে গেল।

মাস পেরিয়েও দোকান খোলে না।
কদম আলী জার্মানীতে তার পুরো সময়টাই সরকারি সাহায্যে চলেছে। সুতরাং করোনাকালীন জরুরি সরকারি সাহায্য হিসেবে আলাদা করে তার কিছু পাবার নেই। মার্চের শুরুতে দেশে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন চাইলেও আর পাঠানো যাবে না। বিমান চলাচল বন্ধ।

দুমাসের মাথায়ও দোকান খুলতে পারে না।
শামসু ভাইয়ের করোনা পজিটিভ। পড়ে আছেন হাসপাতালে। সম্ভবত আর ফিরবেন না।

গত পরশু দুই একটা দোকান একটু করে খোলে। বহু দোকান বন্ধই থাকে। আশেপাশের অনেক দোকান হয়ত আর কোনদিনই খুলবে না।

কদম আলী ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবে।



1 comment:

Creative Buildingbd said...

Creative Buildingbd is the best Self-leveling epoxy Flooring service provider in Bangladesh. Self-leveling epoxy floor users will get best Self-leveling epoxy floor at an affordable price from us.