Saturday, July 11, 2009

একমাত্র তোমাকে সত্য বলে মানি

১.

মাথাটা হাঁটুতে গুঁজে টেনশন কমাবার চেষ্টা চলছিল। মালগাড়িতে এমনিতে টিকিট চেকার সচরাচর আসে না। তারপরেও এসে পড়লে মুশকিল। ঢাকাগামী যাত্রীবাহী ট্রেন মিস করে গয়রহ মফিজদের সাথে চরে বসেছে মালগাড়িতে। চেকার যদি আসেও কিছু পয়সা দিলে কথা বাড়াবে না। ভয় আসলে চেকারকে না পুলিশকে। চেকার যদি হুট করে ঠোলা ডেকে বসে তাহলেই সর্বনাশ। কোমরে গোঁজা পিস্তলে এখনো রাউন্ড দুয়েক গুলি জীবিত আছে। যাত্রীবাহী ট্রেন মিস করে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। সেখানে প্রায়ই ঠোলারা উঠছে। নয়তো টিকটিকি গিজগিজ করছে এখানে সেখানে।

কিন্তু মফিজ শব্দটা তার মাথায় কি করে এলো? সে না সর্বহারা? না। সে সর্বহারা নয়। সর্বহারার শ্লোগান দিলেই কেউ সর্বহারা হয়ে যায় না। সে কেরানির সন্তান। বাপ বহু কষ্টে পড়িয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে পেটি শব্দটা ইরেজার দিয়ে মুছে শুধু বুর্জোয়া হতে পারে। নামটাও রেখেছে সেই মডেল অনুসরণ করে। ফয়সাল খন্দকার। খন্দকাররা সর্বহারা হয় না। তাদের ডাক নামও ফয়সাল হয় না। রেলগাড়িতে নিদেনপক্ষে সেকেন্ডক্লাসে যাতায়াত করা যাত্রীরা খুচরো পয়সা দিয়ে মালগাড়ি চড়া হতদরিদ্র দিনমজুরদের মফিজ বলে ডাকে। যতই লালবই পড়ুক না কেন পেটিবুর্জোয়া খাসলত উবে যায় নি। কারোই কি যায়? হয়তো যায় হয়তো যায় না।

বগীর ভিতরে সে ছাড়া আর আটজন মফিজ মানে দিনমজুর। সাথে একটা করে টুকরি আর কোদাল। না, সবার কোদাল নেই। কোদাল সবমোট তিনটা। এরা তাহলে সবাই মাটি কাটা শ্রমিক নয়। যাদের কোদাল নেই তারা সম্ভবত যোগালী। মিনিট দশেক আগে উঠেছে। মাঝে একজন দুজন কয়েকবার করে তার দিকে উৎসুক দৃষ্টি দিয়েছে।
- ডাহা যাবায়?
একজন জিজ্ঞাসা করলো।
- ঊ? হয়।
কোন রকমে জবাব দিয়ে আবারো ঝিমায় ফয়সাল। আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না। হয়তো বুঝে নেয় ঢাকায় নেমে তাদের মতোই কামলার সন্ধানে দৌড়াতে হবে। তাই পথের সময়টুকুই একটু বিশ্রাম। কিন্তু ফয়সালের ভয় কাটে না। ভৈরব/নরসিংদী এলাকার ভাষা তার আসে না।

কিন্তু ওরা একটু পর পর ওর দিকে তাকাচ্ছে কেন? ওরা কি পার্টির কেউ? নাকি পুলিশের ইনফর্মার? নাকি নিতান্ত নিরিহ সর্বহারা?

গাড়ি তেজগাঁ পৌঁছতে আরো চল্লিশ মিনিটের মতো বাকি। খুব সাবধানে একবার কোমর চুলকাবার ভান করে পিস্তলটা অনুভব করে নেয়। তারপর খুব সহজভাবে গামছায় বাঁধা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিটা বামপাশে খড়ের উপরে এনে রাখে। একজন মফিজের মুখে হাসি দেখা যায়।
- তুমার বউ নানছুইন?
একটা বোকা বোকা হাসি দেয়। ওরাও হাসে। হাসি দেখে কিছু বোঝা যায় না, নির্দোষ হাসি না শিকার ধরা হাসি।

আচ্ছা নির্দোষ হাসি কী?

ট্রেন ঘটাঙ ঘটাঙ করে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বাজে সোয়া এগারোটা। সকাল। আরো সকালে হলে মালগাড়িতে শ্বাস ফেলারও জায়গা থাকতো না। তাতে ধরা পড়ার চান্স বেশী ছিল। হয় ধরা পড়তো নয় মাল খোয়াতো।

গাড়ি সামান্য ঝাঁকি খেতে ফয়সাল কাৎ হয়ে পড়লো তাঁর পোটলার উপর। আর একটু হলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো। গিঁটের উপর ধাক্কা লাগাতে ঢাকনা খানিক ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। তাতে মুহুর্তের জন্য শেখ মুজিবের ছবিওয়ালা বড় নোট উঁকি দিয়েছিল। দ্রুত সামলে না নিলে কী হতো? ভাবতে ভয় করছে।

এতো ভয় আগে কখনো করেনি। এমন কি শেষ রাতে মাহফুজের মাথায় বুলেট ভরে দেবার সময়ও না। খুব দক্ষতার সাথে খড়ের গাঁদায় পুঁতে রেখে এসেছে। রক্তমাখা খড়গুলো ভিতরে দিয়ে তার উপর দিয়ে মোটামুটি দুই ফুট পুরু করে খড় বিছিয়েছে। লাশ বের হতে তিনদিন। আর লাশ পঁচে দুর্গন্ধ বের হতে কতদিন?

মাহফুজ এসেছিল তাকে খতম করতে। কসবা বাজারের মহিউদ্দিন শেখের বাড়িতে রাজনৈতিক ডাকাতি থেকে ফেরার পথে ফয়সালের লাশ ফেলে টাকা নিয়ে আজ বিকালের মধ্যেই গৌরনদী ফেরার কথা ছিল মাহফুজের। পার্টি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ফয়সালকে। গত শুক্রবার সন্ধ্যার গোপন মিটিঙে সিনিয়র কমরেডদের সামনে খতমের লাইন এর বিরোধীতা করার কারণে। শুধু তাই নয় ফয়সালের বিরুদ্ধে পার্টির টাকা আত্মসাতেরও নাকি অভিযোগ আছে। আর সেটা নেতাদের জানিয়েছিল মাহফুজ। টাকার ভাগ দেওয়া সত্ত্বেও মাহফুজ বিশ্বাসঘাতকতা করলো তার সাথে। অথচ স্কুল জীবনের বন্ধু। রাজনৈতিক বিশ্বাস কত অন্ধ করে দেয় মানুষকে। কী হবে মহিউদ্দিন শেখের মতো কয়েকটা জানোয়ারকে মেরে তাদের সিন্দুক খালি করে? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরো পঁচিশটা মহি শেখ উঠে দাঁড়াবে। বিপ্লব মানে ব্যবস্থার পরিবর্তন। ইণ্ডিভিজুয়াল টেরোরিজম না। বলেছিলেন ট্রটস্কি। ট্রটস্কি আরো কী কী যেন বলেছিলেন......?...

ট্রেনের দুলুনিতে আবারো চোখ ধরে আসে ফয়সালের........

২.

শ্যাম্পেনের কর্কটা শব্দ করে খুলে ভুশ করে সবার গায়ে খানিকটা ছিঁটে যেতেই তুমুল হাততালি। টেবিলের উপরে রাখা ছয়টা গ্লাসে খুব দক্ষতার সাথে ঢেলে ফেলা গেলো। প্রফেসার হপকিন্স গ্লাস উপরে তুলে বললেন, হোয়ার ইজ ইউর গ্লাস ইয়াং ম্যান? ইউ আর এ ডক্টর নাউ! ফয়সাল লজ্জিত মুখে আরেকটা গ্লাসে খানিক ঢেলে নিতে প্রফেসার বললেন, চিয়ার্স!

সবাই এসেছেন। প্রফেসার হপকিন্স, তাঁর আন্ডারে পোস্টডক স্টুডেন্ট মারিয়া পিটারসন, সোশাল সাইকোলজির ড. রুজভেল্ট হগ, গ্লোবাল পলিটিক্যাল ইকোনমির ড. সেবাস্তিয়ান ক্লুগ, পলিটিক্যাল অ্যানথ্রোপলজির রয় অ্যান্ডারসন আর তাঁর সেক্রেটারি প্রিয়দর্শিনী শ্যারন গিডেন্স। সবার হাতে শ্যাম্পেনের গ্লাস। চুমুক দিতে দিতে সবাই বিশ্বব্যাঙ্ক আর আইএমএফের পিণ্ডি চটকাচ্ছেন।

প্রফেসার হপকিন্স একটু সরে আসেন ফয়সালের দিকে। উই হাইলি এপ্রিসিয়েট য়ূর ডেভেলপমেন্ট মডেল কনসার্নিং মাইক্রোলেভেল এগ্রিকালচার উইথ এ ভেরি কনট্রোলড লেভেল অফ মাইক্রোক্রেডিট। দিস ইজ নট নিউ এনিওয়ে, বাট দ্য ওয়ে ইউ ডিড য়ূর প্রেজেন্টেশান ওয়াজ রিয়েলি কনভিন্সিং।
- থ্যাঙ্ক য়ূ! বলে একটা লাজুক হাসি দিলো ফয়সাল।
- বাট খন্দকার, হাভানা চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে হপকিন্স বলতে থাকেন, ইফ ইউ গেট দ্য ফান্ড, ইউ মাইট হ্যাভ টু চেইঞ্জ এ বিট। য়ূর প্রোপোজাল আই মিন। আফটার অল.....ওয়ার্ল্ড ক্যাপিট্যালিজম ইজ পেইং ফর দ্য চেইঞ্জ। হা হা হা....
- আই নো স্যার।
- আই উইশ য়ূ ডু! সো ইঞ্জয় য়ূর সেলফ ইয়াং ম্যান। বেস্ট অফ লাক! ......অ্যান্ড ওয়ান মোর থিঙ। ডু য়ূ হ্যাভ সিকিউরিটি প্রবলেমস গেটিং ব্যাক টু ইউর কান্ট্রি?
- আই ডোন্ট থিঙ্ক স্যার। থিঙস্ হ্যাভ চেইঞ্জড আ লট ইন লাস্ট ফিফটিন ইয়ারস....

বিকেলে একা একা হাডসন নদীর ধারে হাওয়া খায় ফয়সাল। জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো হাভানা চুরুট ধরায়। একেকটা চুরুটে কত সেন্ট করে যায় সমাজতন্ত্রের পকেটে? ফিডেল বলতে পারবে। হয়তো পারবে না.....চে কি পারতো?

৩.

- সার বাড়িজ্জাই...কাম শ্যাষ আইজকার মতো।
- হুঁ...কতবার বলছি আমারে সার বলবা না! ভাই বলবা। নাইলে নাম ধইরাও ডাকতে পারো।
- আইচ্ছা খনকার সাব..
- আবারো সাব?
মফিজ মিয়া হাসে। তার পানবিড়ি খাওয়া দাঁত দেখা যায়। আগামী টার্মের ফান্ডটা এসে গেলেই সবাইকে একবার হাভানা চুরুট খাওয়াতে হবে।

ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক খুব খুশী ফয়সালের উপর। পোস্ট কলোনিয়াল সমাজে কনজিউমারস বিহেভিয়ার বদলাতে ফয়সালের মডেল নিয়ে পশ্চিমে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে। ফয়সাল অবশ্য তাঁর যৌবনের রাজনৈতিক অঙ্গীবার ভোলেনি। তাঁর লক্ষ্য তো আসলে কনজিউমারস বিহেভিয়ার পরিবর্তন নয়। তাঁর লক্ষ্য সমাজকে সত্যি সত্যি বদলে দেওয়া। তাই শুধুমাত্র বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের কর্মঠ আর তুখোড় বুদ্ধিমান ছেলেমেয়েরাই এই প্রজেক্টে চাকরি পায়। ক্যারিয়ার বাঁচিয়ে সমাজ পরিবর্তনের এই যূগান্তকারী মডেল যদি ফয়সালের যৌবনে থাকতো বহু মেধাবী প্রাণ অকালমৃত্যু থেকে বেঁচে যেতো।

মার্কসিজম ইজ নট আ ডগমা বাট এ গাইড টু অ্যাকশান......বলেছিলেন কমরেড স্তালিন। লোকটা ট্যালেন্টেড ছিলেন। শুধু কয়লা খনি শ্রমিকের রূঢ়তা থেকে বের হতে না পেরে অতগুলি মানুষের রক্তে হাত ভেজালেন.......

মার্কসিজম ইজ নট আ ডগমা বাট এ গাইড টু অ্যাকশান......খুব খাঁটি কথা বলেছিলেন কমরেড। নিজের সাফল্যে আজ খানিক গর্বও হয় ফয়সালের। হ্যা...গাইড টু অ্যাকশান....অ্যাকশানেই প্রয়োগ, কর্ম....আমল.....

No comments: