মঙ্গলবার ২৩.০২.২০১০
আবারো জঘন্য আবহাওয়া। সেই ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে এক্কেবারে এই সপ্তাহান্তের শুরু পর্যন্ত টানা তুষারপাত আর বদখৎ শীতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম ঠিক। রবিবার নাগাদ তুষারপাত থেমেছে, তাপমাত্রা বাড়ছে, বরফ গলছে এগুলিও সব ঠিক। সমস্যা হচ্ছে বরফ গলবার সাথে সাথে গুরফগুলিও হিমবাহের আগের তাজা চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে। সাড়ে ষোলকলা হিসাবে গতরাত থেকে শুরু হয়েছে চিত্তক্ষয়কর টিপটিপ বৃষ্টি। মনে জিলাপি বানানো রঙ থাকলে কেউ হয়তো বলবেন মন খারাপ করা দিন। আমি বলবো মেজাজ খারাপ করা আবহাওয়া। কোন কাজে তো মন দেওয়াই যায় না কোথাও যাওয়াও যায় না। যেতে বাধ্য হলেই গুরফ বাস্তবতার মুখোমুখি। সক্কালে এরকম বাধ্য হয়ে একবার বের হতে হওয়ায় মেজাজ চড়তে চড়তে তালু থেকে বিঘৎখানেক চড়ে ব্রহ্মকে ঠাস করে চটকানা লাগাতে গিয়ে সামনে পেলাম জানালার পাল্লা। হাতের ব্যাথায় ঘরের মধ্যে নাচলাম কিছুক্ষণ। তারপর আবার বসে থাকলাম কতক্ষণ ব্যাজার হয়ে। খানিক ক্ষুধা ছিল। খেতে বসেই সব অ্যাপেটাইট গায়েব। মনে হচ্ছিল সদ্য জ্বাল দেওয়া বীয়ার দিয়ে ফ্রোজেন বিরিয়ানি খাচ্ছি। কফি বানাতে গিয়ে দেখি দুধ শেষ। রাগের চোটে চিনিও নিলাম না। কফি বানিয়েছিলামও এ্যাত্তোগুলি। কাপে না ৩৩০ এমএল এর একটা বীয়ারের মগ ভরে নিয়ে এসে বসলাম কম্পুর সামনে। ভাবছিলাম যে দিনের কফিনে এবার পেরেক ঠুকবে ইন্টারনেট। হয় থাকবে না নয়তো চলবে আমার হাতে তৃতীয় প্রচেষ্টায় রান আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের মতো।
কফির মগে চুমুক দিতেই ম্যাজিক! রীতিমতো অশ্লিল এক মগ কফি। যাকে বলে উদ্ভিন্ন যৌবনা। ৩৩০ এমএল তাড়িয়ে তাড়িয়ে চাটলাম। তারপর আরো এক মগ। কাজে মন দিতে চেষ্টা করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি খুলির ভিতর ঝাঁকে ঝাঁকে নতুনপুরনো কথা থ্রিডি প্যারানয়েড শুরু করে দিলো। বাইরে যাবার উপায় নেই জানালা খুলে ঘরের মধ্যেই বিড়ি ধরাই। বৃষ্টির তেজ আরেক্টু বাড়ে। অতীত থেকে ছেঁকে ছেঁকে মন খারাপ না করা সময়গুলিকে এক এক করে টেনে আনতে থাকি।
ধরা খাওয়ার প্রতিযোগীতা ছাড়া কোন দিন কোথাও প্রথম হয়েছিলাম? হয়েছিলাম। একবারই। জীবনে প্রথম আর শেষবারের মতো। স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায়। গান, আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতার মতো "ভালো" কিছুতে না। কৌতুকে। লোক হাসিয়ে সেই একবারই পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠেছিলাম তুমুল করতালির মধ্যে। নবদ্বীপ হালদারের সেই "দেখি না কী করে" সাধ্যমতো নকল করে কাঁপিয়ে দিয়েছিলাম। বেঁচে থাকলে তাঁর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতাম অতিনিম্নমানের মিমিক্রির জন্য। আমি তখন ইঁচড়ে পাকা ক্লাস সিক্স। তিনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করতেন। নকলের অসুবিধা হচ্ছে রসদ ঝাল সবই অতি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তাই পরের বছর ভানু বন্দোপাধ্যায়ের "বাবা পাকিস্তান"এর মতো ধ্রুপদী কৌতুক ঝেড়েও স্বত:স্ফুর্ত মিমিক্রিতে অক্ষমতার কারণে ২য় পুরস্কার নিয়ে প্রতিযোগীতার লাইনে ক্ষ্যামা দিতে হলো সারা জীবনের জন্য। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম অন্যের কৌতুক নকল করার মধ্যে তেমন কোন কৃতিত্ব নাই। নিজে থেকে রসাত্মক কিছু তৈরী করতে পারাটাই আসল। আর সেইটা শিল্পকলার আর যেকোন সৃষ্টিশীল ধারার থেকে কোন অংশে কম কঠিণ না। স্কুল পার হতে হতে বুঝতে পারলাম রসসৃষ্টির জায়গাটায় আমার প্রচণ্ডরকম ঘাটতি রয়েছে। আত্মীয়বন্ধু পরিমণ্ডলে আমি সব থেকে কম রসিক। সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর ভানু, জহর রায় নবদ্বীপ হালদারে আচ্ছন্ন শৈশব-কৈশরের শেষ মাথায় এই ধরণের উপলব্ধির বেদনা নিয়ে স্কুল পার হলাম। তারপর থেকে শুধুই রসগ্রাহী। চ্যাড়াব্যাড়া জীবন থেকে হাস্যরসগুলি ছেঁকে ছেঁকে আলাদা করে সেভ করে রাখা। এটা মৌলিক কিছু না। তবু এই করে স্মৃতিতে সেঁক দিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখি রসগ্রাহীতার ব্যাপারটাও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের একাংশের প্রবল আক্রমণের মুখে। কারণ যেভাবেই হোক যেকোন রসিকতাই কাউকে না কাউকে আহত করে। সবার জন্য হাসি বলে কিছু নাই। আহতের দুষ্টিতে বিশ্ববীক্ষা তৈরী করতে না পারলে মহাপাতক হবে। সুতরাং হাস্যরস হতে হবে গঠণমূলক। স্যাটায়ারও নাকি সেই ক্যাটেগরিতে পড়ে না। কারণ সেখানেও একটা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আরেক্টা দৃষ্টিভঙ্গীকে আক্রমণ করা হয়। হাসতেই যদি হয় তবে সেটা হতে হবে নির্মল হাসি। মীর মশাররফ হোসেন হলে আমার পাশের ঘরের নির্মলেন্দু সিংহকে চিনলেও নির্মল হাসিকে আর চেনা হয়ে উঠলো না। তাই ঐ আধুনিকতা-পরবর্তী নীতিদর্শনকে ঝাঁটা মারতে একদম দেরী হলো না। মিশে গেলাম জনস্রোতে। যেখানে জীবনের হাজার হাজার জটিলতার মুখেও জনগণ খুব অনৈতিকভাবে হাসছে। সেখানে দার্শনিক নিক্তির বেইল নাই। মানুষ বাঁচে এবং আরো বাঁচতে চায়। হাসে এবং আরো হাসতে চায়। যতক্ষণ হাসে ততক্ষণ জীবিত থাকে। দারিদ্র্য, শোক, প্রতিবাদ, শোষণ, জ্বালা, যন্ত্রণা, সিনসিনানি'র সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে হাসে। অবস্থানমতো নৈতিকতা নির্ধারণ করে নেয়। আর সেখানে গণমানুষের অবস্থান মধ্যবিত্তের আরোপিত নৈতিকতার থেকে অনেক অনেক বেশী শক্তিশালী। যে কারণে উঁচুতলার মানুষ আর তাদের অনুকরণকারী মধ্যবিত্ত সব থেকে কম হাসতে পারে।
ফিরে আসি কফির মগে। জানালায় উঁকি দেই। আকাশে নিশ্ছিদ্র মেঘ। আবহাওয়াটা অন্তত আমার থেকে কম রসিক। এই ভেবে একটু খুশী হতে চেষ্টা করি। আরেক্টা বিড়ি ধরাই। ভাবতে বসেছিলাম কমেডির কথা। শুরু করলাম ব্যক্তিগত সাতকাহন। এরকম হওয়া একদম ঠিক্না। যদিও এরকম অশ্লিল আবহাওয়ায় ঠিকবেঠিক লাইন রাখা মুস্কিল।
বুধবার ২৪.০২.২০১০
মন খারাপ থাকলে কখনো গান শুনতেও ভালো লাগে না। সব থেকে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে হন্ হন্ করে হাঁটা। আবহাওয়া সে ইচ্ছায় বাগড়া দিলে আরো কফি খাই। সচলায়তনে ঘুরি। কোন পোস্ট মনে ধরলে পড়ি। লিখতে পারলে মন একটু দ্রুত ভালো হয়। কিন্তু এরকম অবস্থায় আঙ্গুল কী-বোর্ড থেকে দূরে সরে যায়। মাউস নাড়ার থেকে বেশী শ্রম সহ্য হয় না।
ইউটিউবে ধুনফুন খুঁজি। স্ট্যান্ড আপ কমেডি একটা ভালো অ্যাপেটাইজার। রোয়ান অ্যাটকিনসনের ভিডিওগুলি গত ক'বছরে মোটামুটি হাজার খানেকবার দেখা হয়েছে। মাতৃভাষায় কিছু দেখতে শুনতে মন চায়। তখন মীরাক্কেল দেখি। আগে দেখতাম না। দীর্ঘ প্রবাসে থেকে মীর নামের যে লোকটা ডিডি বাংলায় খাস খবর পড়তো সে যে এর মধ্যে লাফটার শো'র হিরো হয়ে উঠেছে তা আর জানা হয়ে ওঠেনি। গত নভেম্বরে হিমুর এই পোস্ট থেকে মীরের উপর নজর পড়ে। আমার টানা খারাপ দিনকালের মোটামুটি চরম সময়টার ফাঁকেফুকে টুকটাক দেখতে থাকি। ইউটিউবে থাকা মীরাক্কেল আর এনজয় গুরুর প্রায় সব পর্বই দেখে ফেলি।
দুনিয়ায় এতো কিছু থাকতে লাফটার শো কেন দেখলাম জাতীয় প্রশ্ন নিজেকে বার দুইতিনেকের বেশী করা হয়ে ওঠে নাই। কয়েকটা পারফর্মমেন্স ফেভারিটেও যোগ হয়ে গেলো। কয়েকজন নজরেও পড়ে গেলো। চরম দু:সময়ে বালছালে টাইমপাসের প্রবণতা বাড়ে। আর দু:সময়ে হাসাতে পারা বস্তুর খানিক অতিমূল্যায়ন জৈবিক নিয়মেই হতে থাকে। আবার কাজে মন দিতে পারার সময় এলে দেখা গেলো হাঁফ ছাড়ার সময়টাতেও ঐ লাফটার শো'ই দেখছি। এবার দেখি বিচারকের অবস্থান থেকে। মীরাক্কেল থ্রীর দুই ফাইনালিস্ট মৃদুল ভট্টাচার্য, দীপাংশু আচার্য্য দুজনকেই গুল্লি লাগলো।
আর এনজয় গুরুতে দীপাংশু-সায়নের যৌথ পারফর্মেন্সগুলি এককথায় লা-জওয়াব।
তারপর সিলভেস্টারের কয়েকদিন পরে হঠাৎ দেখি ইউটিউবে নতুন মীরাক্কেলের লিঙ্ক। ৫ নম্বর সেশন শুরু হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর থেকে। অন্যায় রকম ভাবে কর্মক্লান্তির সময়গুলিতে তার প্রতিটা পর্বই দেখছি। দেখতে দেখতে মনটা আবারো একটু খারাপ হয়। বাংলাদেশে অনেক বড় বড় কমেডিয়ান ছিলেন। মেধা অনুপাতে মূল্যায়ণ পান নাই। রবিউল, আশীষ কুমার লৌহ, খান জয়নুলদের নাম এখন অনেকেই আর জানেন না বা মনে করেন না। আশির দশকে ফজলে লোহানি "যদি কিছু মনে না করেন" নামের ধ্রুপদী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করতেন। ফজলে লোহানির রাজনৈতিক ইতিহাস সুবিধার না হলেও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠাণ পরিচালনায় তিনি একটা মৌলিক মাইলস্টোন পুতে গেছেন। "যদি কিছু মনে না করেন" থেকে বেশ কিছু শক্তিশালী কৌতুকাভিনেতা উঠে এসেছিলেন। আশির দশকের শেষে হানিফ সংকেত ফজলে লোহানির একরকম অনুকরন করেই "ইত্যাদি" নামের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠাণ শুরু করেন। প্রথম কয়েক বছরে ইত্যাদি'র সাথে বর্তমান পর্বগুলির তুলনা করলে হতাশ হতে হয়। শুধু ইত্যাদি না গত দুই দশকে আরো যত বিচিত্রানুষ্ঠাণ এসেছে কোনটাই মিনিট দশেকের বেশী দেখা যায় না। ইত্যাদি'টাই মাঝে মধ্যে দেখতাম কিছু মজার আশায়। হতাশ হতে হতে একসময় সেটাও বাদ দিয়েছি। হতাশার কারণ হতে পারে হয়তো আমার হাস্যরসাগ্রাহণে কোন পরিবর্তন এসেছে অথবা হয়তো তাঁরা আর সত্যিই হাসাতে পারছে না অথবা দুইটাই।
মীরাক্কেলগুলি দেখতে দেখতে ভাবি দেশে কি আসলেই রসিক মানুষের অভাব পড়েছে, নাকি চ্যানেলগুলি লাফটার শো করার ঝুঁকির মধ্যে যেতে চায় না। বাজারে চাহিদা থাকা স্যাটায়ার দেখে ইজি থাকার সংস্কৃতিতেই হয়তো আমাদের মিডিয়াগুলি আসতে পারে নাই। তাই সম্ভাবনাগুলি আমার মতো এই খালি পেটের ভাবনাগুলিতেই অক্কা পাচ্ছে।
আজ দুপুর থেকে আবার রোদ একটু একটু উঁকি দিচ্ছে। একটু বের হবার মতো পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। যাবার আগে চন্দ্রবিন্দুর একটা গান ঝুলিয়ে গেলাম। চন্দ্রিল ভট্টাচার্যকেও ভাল্লাগছে ...:D
আবারো জঘন্য আবহাওয়া। সেই ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে এক্কেবারে এই সপ্তাহান্তের শুরু পর্যন্ত টানা তুষারপাত আর বদখৎ শীতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম ঠিক। রবিবার নাগাদ তুষারপাত থেমেছে, তাপমাত্রা বাড়ছে, বরফ গলছে এগুলিও সব ঠিক। সমস্যা হচ্ছে বরফ গলবার সাথে সাথে গুরফগুলিও হিমবাহের আগের তাজা চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে। সাড়ে ষোলকলা হিসাবে গতরাত থেকে শুরু হয়েছে চিত্তক্ষয়কর টিপটিপ বৃষ্টি। মনে জিলাপি বানানো রঙ থাকলে কেউ হয়তো বলবেন মন খারাপ করা দিন। আমি বলবো মেজাজ খারাপ করা আবহাওয়া। কোন কাজে তো মন দেওয়াই যায় না কোথাও যাওয়াও যায় না। যেতে বাধ্য হলেই গুরফ বাস্তবতার মুখোমুখি। সক্কালে এরকম বাধ্য হয়ে একবার বের হতে হওয়ায় মেজাজ চড়তে চড়তে তালু থেকে বিঘৎখানেক চড়ে ব্রহ্মকে ঠাস করে চটকানা লাগাতে গিয়ে সামনে পেলাম জানালার পাল্লা। হাতের ব্যাথায় ঘরের মধ্যে নাচলাম কিছুক্ষণ। তারপর আবার বসে থাকলাম কতক্ষণ ব্যাজার হয়ে। খানিক ক্ষুধা ছিল। খেতে বসেই সব অ্যাপেটাইট গায়েব। মনে হচ্ছিল সদ্য জ্বাল দেওয়া বীয়ার দিয়ে ফ্রোজেন বিরিয়ানি খাচ্ছি। কফি বানাতে গিয়ে দেখি দুধ শেষ। রাগের চোটে চিনিও নিলাম না। কফি বানিয়েছিলামও এ্যাত্তোগুলি। কাপে না ৩৩০ এমএল এর একটা বীয়ারের মগ ভরে নিয়ে এসে বসলাম কম্পুর সামনে। ভাবছিলাম যে দিনের কফিনে এবার পেরেক ঠুকবে ইন্টারনেট। হয় থাকবে না নয়তো চলবে আমার হাতে তৃতীয় প্রচেষ্টায় রান আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের মতো।
কফির মগে চুমুক দিতেই ম্যাজিক! রীতিমতো অশ্লিল এক মগ কফি। যাকে বলে উদ্ভিন্ন যৌবনা। ৩৩০ এমএল তাড়িয়ে তাড়িয়ে চাটলাম। তারপর আরো এক মগ। কাজে মন দিতে চেষ্টা করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি খুলির ভিতর ঝাঁকে ঝাঁকে নতুনপুরনো কথা থ্রিডি প্যারানয়েড শুরু করে দিলো। বাইরে যাবার উপায় নেই জানালা খুলে ঘরের মধ্যেই বিড়ি ধরাই। বৃষ্টির তেজ আরেক্টু বাড়ে। অতীত থেকে ছেঁকে ছেঁকে মন খারাপ না করা সময়গুলিকে এক এক করে টেনে আনতে থাকি।
ধরা খাওয়ার প্রতিযোগীতা ছাড়া কোন দিন কোথাও প্রথম হয়েছিলাম? হয়েছিলাম। একবারই। জীবনে প্রথম আর শেষবারের মতো। স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায়। গান, আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতার মতো "ভালো" কিছুতে না। কৌতুকে। লোক হাসিয়ে সেই একবারই পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠেছিলাম তুমুল করতালির মধ্যে। নবদ্বীপ হালদারের সেই "দেখি না কী করে" সাধ্যমতো নকল করে কাঁপিয়ে দিয়েছিলাম। বেঁচে থাকলে তাঁর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতাম অতিনিম্নমানের মিমিক্রির জন্য। আমি তখন ইঁচড়ে পাকা ক্লাস সিক্স। তিনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করতেন। নকলের অসুবিধা হচ্ছে রসদ ঝাল সবই অতি দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তাই পরের বছর ভানু বন্দোপাধ্যায়ের "বাবা পাকিস্তান"এর মতো ধ্রুপদী কৌতুক ঝেড়েও স্বত:স্ফুর্ত মিমিক্রিতে অক্ষমতার কারণে ২য় পুরস্কার নিয়ে প্রতিযোগীতার লাইনে ক্ষ্যামা দিতে হলো সারা জীবনের জন্য। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম অন্যের কৌতুক নকল করার মধ্যে তেমন কোন কৃতিত্ব নাই। নিজে থেকে রসাত্মক কিছু তৈরী করতে পারাটাই আসল। আর সেইটা শিল্পকলার আর যেকোন সৃষ্টিশীল ধারার থেকে কোন অংশে কম কঠিণ না। স্কুল পার হতে হতে বুঝতে পারলাম রসসৃষ্টির জায়গাটায় আমার প্রচণ্ডরকম ঘাটতি রয়েছে। আত্মীয়বন্ধু পরিমণ্ডলে আমি সব থেকে কম রসিক। সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর ভানু, জহর রায় নবদ্বীপ হালদারে আচ্ছন্ন শৈশব-কৈশরের শেষ মাথায় এই ধরণের উপলব্ধির বেদনা নিয়ে স্কুল পার হলাম। তারপর থেকে শুধুই রসগ্রাহী। চ্যাড়াব্যাড়া জীবন থেকে হাস্যরসগুলি ছেঁকে ছেঁকে আলাদা করে সেভ করে রাখা। এটা মৌলিক কিছু না। তবু এই করে স্মৃতিতে সেঁক দিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখি রসগ্রাহীতার ব্যাপারটাও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের একাংশের প্রবল আক্রমণের মুখে। কারণ যেভাবেই হোক যেকোন রসিকতাই কাউকে না কাউকে আহত করে। সবার জন্য হাসি বলে কিছু নাই। আহতের দুষ্টিতে বিশ্ববীক্ষা তৈরী করতে না পারলে মহাপাতক হবে। সুতরাং হাস্যরস হতে হবে গঠণমূলক। স্যাটায়ারও নাকি সেই ক্যাটেগরিতে পড়ে না। কারণ সেখানেও একটা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আরেক্টা দৃষ্টিভঙ্গীকে আক্রমণ করা হয়। হাসতেই যদি হয় তবে সেটা হতে হবে নির্মল হাসি। মীর মশাররফ হোসেন হলে আমার পাশের ঘরের নির্মলেন্দু সিংহকে চিনলেও নির্মল হাসিকে আর চেনা হয়ে উঠলো না। তাই ঐ আধুনিকতা-পরবর্তী নীতিদর্শনকে ঝাঁটা মারতে একদম দেরী হলো না। মিশে গেলাম জনস্রোতে। যেখানে জীবনের হাজার হাজার জটিলতার মুখেও জনগণ খুব অনৈতিকভাবে হাসছে। সেখানে দার্শনিক নিক্তির বেইল নাই। মানুষ বাঁচে এবং আরো বাঁচতে চায়। হাসে এবং আরো হাসতে চায়। যতক্ষণ হাসে ততক্ষণ জীবিত থাকে। দারিদ্র্য, শোক, প্রতিবাদ, শোষণ, জ্বালা, যন্ত্রণা, সিনসিনানি'র সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে হাসে। অবস্থানমতো নৈতিকতা নির্ধারণ করে নেয়। আর সেখানে গণমানুষের অবস্থান মধ্যবিত্তের আরোপিত নৈতিকতার থেকে অনেক অনেক বেশী শক্তিশালী। যে কারণে উঁচুতলার মানুষ আর তাদের অনুকরণকারী মধ্যবিত্ত সব থেকে কম হাসতে পারে।
ফিরে আসি কফির মগে। জানালায় উঁকি দেই। আকাশে নিশ্ছিদ্র মেঘ। আবহাওয়াটা অন্তত আমার থেকে কম রসিক। এই ভেবে একটু খুশী হতে চেষ্টা করি। আরেক্টা বিড়ি ধরাই। ভাবতে বসেছিলাম কমেডির কথা। শুরু করলাম ব্যক্তিগত সাতকাহন। এরকম হওয়া একদম ঠিক্না। যদিও এরকম অশ্লিল আবহাওয়ায় ঠিকবেঠিক লাইন রাখা মুস্কিল।
বুধবার ২৪.০২.২০১০
মন খারাপ থাকলে কখনো গান শুনতেও ভালো লাগে না। সব থেকে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে হন্ হন্ করে হাঁটা। আবহাওয়া সে ইচ্ছায় বাগড়া দিলে আরো কফি খাই। সচলায়তনে ঘুরি। কোন পোস্ট মনে ধরলে পড়ি। লিখতে পারলে মন একটু দ্রুত ভালো হয়। কিন্তু এরকম অবস্থায় আঙ্গুল কী-বোর্ড থেকে দূরে সরে যায়। মাউস নাড়ার থেকে বেশী শ্রম সহ্য হয় না।
ইউটিউবে ধুনফুন খুঁজি। স্ট্যান্ড আপ কমেডি একটা ভালো অ্যাপেটাইজার। রোয়ান অ্যাটকিনসনের ভিডিওগুলি গত ক'বছরে মোটামুটি হাজার খানেকবার দেখা হয়েছে। মাতৃভাষায় কিছু দেখতে শুনতে মন চায়। তখন মীরাক্কেল দেখি। আগে দেখতাম না। দীর্ঘ প্রবাসে থেকে মীর নামের যে লোকটা ডিডি বাংলায় খাস খবর পড়তো সে যে এর মধ্যে লাফটার শো'র হিরো হয়ে উঠেছে তা আর জানা হয়ে ওঠেনি। গত নভেম্বরে হিমুর এই পোস্ট থেকে মীরের উপর নজর পড়ে। আমার টানা খারাপ দিনকালের মোটামুটি চরম সময়টার ফাঁকেফুকে টুকটাক দেখতে থাকি। ইউটিউবে থাকা মীরাক্কেল আর এনজয় গুরুর প্রায় সব পর্বই দেখে ফেলি।
দুনিয়ায় এতো কিছু থাকতে লাফটার শো কেন দেখলাম জাতীয় প্রশ্ন নিজেকে বার দুইতিনেকের বেশী করা হয়ে ওঠে নাই। কয়েকটা পারফর্মমেন্স ফেভারিটেও যোগ হয়ে গেলো। কয়েকজন নজরেও পড়ে গেলো। চরম দু:সময়ে বালছালে টাইমপাসের প্রবণতা বাড়ে। আর দু:সময়ে হাসাতে পারা বস্তুর খানিক অতিমূল্যায়ন জৈবিক নিয়মেই হতে থাকে। আবার কাজে মন দিতে পারার সময় এলে দেখা গেলো হাঁফ ছাড়ার সময়টাতেও ঐ লাফটার শো'ই দেখছি। এবার দেখি বিচারকের অবস্থান থেকে। মীরাক্কেল থ্রীর দুই ফাইনালিস্ট মৃদুল ভট্টাচার্য, দীপাংশু আচার্য্য দুজনকেই গুল্লি লাগলো।
আর এনজয় গুরুতে দীপাংশু-সায়নের যৌথ পারফর্মেন্সগুলি এককথায় লা-জওয়াব।
তারপর সিলভেস্টারের কয়েকদিন পরে হঠাৎ দেখি ইউটিউবে নতুন মীরাক্কেলের লিঙ্ক। ৫ নম্বর সেশন শুরু হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর থেকে। অন্যায় রকম ভাবে কর্মক্লান্তির সময়গুলিতে তার প্রতিটা পর্বই দেখছি। দেখতে দেখতে মনটা আবারো একটু খারাপ হয়। বাংলাদেশে অনেক বড় বড় কমেডিয়ান ছিলেন। মেধা অনুপাতে মূল্যায়ণ পান নাই। রবিউল, আশীষ কুমার লৌহ, খান জয়নুলদের নাম এখন অনেকেই আর জানেন না বা মনে করেন না। আশির দশকে ফজলে লোহানি "যদি কিছু মনে না করেন" নামের ধ্রুপদী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করতেন। ফজলে লোহানির রাজনৈতিক ইতিহাস সুবিধার না হলেও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠাণ পরিচালনায় তিনি একটা মৌলিক মাইলস্টোন পুতে গেছেন। "যদি কিছু মনে না করেন" থেকে বেশ কিছু শক্তিশালী কৌতুকাভিনেতা উঠে এসেছিলেন। আশির দশকের শেষে হানিফ সংকেত ফজলে লোহানির একরকম অনুকরন করেই "ইত্যাদি" নামের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠাণ শুরু করেন। প্রথম কয়েক বছরে ইত্যাদি'র সাথে বর্তমান পর্বগুলির তুলনা করলে হতাশ হতে হয়। শুধু ইত্যাদি না গত দুই দশকে আরো যত বিচিত্রানুষ্ঠাণ এসেছে কোনটাই মিনিট দশেকের বেশী দেখা যায় না। ইত্যাদি'টাই মাঝে মধ্যে দেখতাম কিছু মজার আশায়। হতাশ হতে হতে একসময় সেটাও বাদ দিয়েছি। হতাশার কারণ হতে পারে হয়তো আমার হাস্যরসাগ্রাহণে কোন পরিবর্তন এসেছে অথবা হয়তো তাঁরা আর সত্যিই হাসাতে পারছে না অথবা দুইটাই।
মীরাক্কেলগুলি দেখতে দেখতে ভাবি দেশে কি আসলেই রসিক মানুষের অভাব পড়েছে, নাকি চ্যানেলগুলি লাফটার শো করার ঝুঁকির মধ্যে যেতে চায় না। বাজারে চাহিদা থাকা স্যাটায়ার দেখে ইজি থাকার সংস্কৃতিতেই হয়তো আমাদের মিডিয়াগুলি আসতে পারে নাই। তাই সম্ভাবনাগুলি আমার মতো এই খালি পেটের ভাবনাগুলিতেই অক্কা পাচ্ছে।
আজ দুপুর থেকে আবার রোদ একটু একটু উঁকি দিচ্ছে। একটু বের হবার মতো পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। যাবার আগে চন্দ্রবিন্দুর একটা গান ঝুলিয়ে গেলাম। চন্দ্রিল ভট্টাচার্যকেও ভাল্লাগছে ...:D
|
No comments:
Post a Comment