Tuesday, February 12, 2013

বাংলাব্লগাবর্তে "ছাগু" শব্দের উৎপত্তি

২০০৬। বাংলাব্লগের ঊষালগ্ন। ২০০৫ এর ডিসেম্বরে শুরু হলেও পোস্ট পড়ার হার বাড়তে শুরু করে জানুয়ারী মাসে। শুরু থেকেই ওয়ালী(আল বদর কামারুজ্জামানের পুত্র), ভূত (সম্ভবত কামারুজ্জামানের বড় ছেলে ওয়ামি), দাদা, ধানসিঁড়ি, মলি, শর্মী, আস্তমেয়ে, ইছামতির পাড়ে, শাওন, ফারিয়াল, সাঈদ আবদুল্লাহ, শরীফ আবদুল্লাহ, সিমরান শিকদার, ত্রিভুজ, দাঁড়াল হাসান ইত্যাদি জামাত সমর্থক কিছু ব্লগার ব্লগ দখলের তালে ছিল। উল্টা দিকে জামাতি পোস্টগুলির নিয়মিত প্রতিবাদ করতো অপ বাক, আড্ডাবাজ, হীরক লস্কর, অমি রহমান পিয়াল, মাসুদা ভাট্টি, তীরন্দাজ, রাসেল( ........), মুখফোড়, শোহেইল মতাহির চৌধুরী, হিমু, মঈন, হাসান, ধুসর গোধুলি, অরূপ, স্বর:হীন, দীক্ষক দ্রাবীড়, কৌশিক, লাল মিয়া, সাধক শঙ্কু, হযবরল, মাশীদ, উৎস'র মতো কয়েকজন। কারো নাম বাদ পড়লে ক্ষমাপ্রার্থী। আর ছিলাম আমি নিজেও। প্রথম প্রথম জামাতি ব্লগাররা মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে না গিয়ে বিভিন্ন আহ্লাদী কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে ডেনমার্কে মহানবীর কার্টুনের মতো বিষয়গুলি গুঁজে দিতো। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, ধর্ম-অধর্ম এইসব নিয়েই চলছিল প্রথম সপ্তাহগুলি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পোস্ট আসতো। রাজাকারী পোস্টও আসতো। প্রতিবাদও হতো। এইসব কিছুর পাশাপাশি আবার সাহিত্যচর্চাও চলছিল। ফেব্রুয়ারী মাসের ২য় সপ্তাহে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ। কামারুজ্জামানপুত্র ওয়ালীর পরিচয় বেরিয়ে পড়ায় সে প্রতিরোধের মুখে পড়ে। মলি নামের ব্লগারটি তার প্রতিবাদে "মেরুদন্ডহীন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি...." নামের পোস্টটা দেন। তুমুল প্রতিবাদ হয়। তারপর থেকে ব্লগের যাবতীয় তর্কবিতর্কের কেন্দ্রে এসে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তর্কে যারা যারা ধর্মীয় মৌলবাদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন তাঁদের সবাই চলে যান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের পক্ষে। মার্চের শুরুতে জঙ্গীবাদ নিয়ে লেখা মাসুদা ভাট্টির ধারাবাহিক উপন্যাস "তরবারির ছায়াতলে"র প্রথম কিস্তি জামাতিব্লগারদের চাপের মুখে বা স্বেচ্ছায় সামহোয়ারইন কর্তৃপক্ষ মুছে দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্লগে মুক্তচিন্তার সমর্থক ব্লগাররা ৫ ও ৬ মার্চ ধর্মঘট করে। এর পর থেকে ব্লগ পরিস্কার দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। ব্রাত্য রাইসু, মাহবুব মোর্শেদ, সাদিক মোহাম্মদ আলম ধরণের কিছু ব্লগার "নিরপেক্ষ" ভাব দেখানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বটম লাইনে এসে রাজাকারপক্ষ গ্রহণ করে ফেলেন। এরপর ১৩ মার্চ আস্তমেয়ের এই পোস্টের ১১ নম্বর কমেন্টে আলবদরপুত্র ওয়ালি প্রগতিশীল ব্লগারদের বেইসবল ব্যাট দিয়ে পেটানোর হুমকি দিলে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক ব্লগাররা তার প্রতিবাদে শিম্পাঞ্জি দিবস পালন করেন। দুষ্টু ছেলে অরূপ কোত্থেকে যেন এই ছবিটা জোগাড় করেন।। ঐ ছবিকে সামনে রেখে শুরু হয় একের পর এক স্যাটায়ার। জামাতিরা চেষ্টা করলো প্রতিরোধের। কিন্তু হলো না। স্যাটায়ার লেখার ক্ষমতা থাকলে ওরা আর মৌলবাদী হবে কেন? ব্রাত্য রাইস, মাহবুব মোর্শেদরা "নিরপেক্ষ"ভাবে ওয়ালিকে বাঁচাতে এসে গনরোষের মুখে পড়লো। যাই হোক, বেইসবলব্যাট হাতে শিম্পাঞ্জিই ছিল ঐ মুহুর্তে একই সাথে ধর্মীয় জঙ্গী আর জামাতশিবিরের প্রতীক।
অনেক কথা বলে ফেলছি। কিন্তু ছাগু আগমনের প্রেক্ষিতটা বোঝাতে কিছুটা অন্তত ইতিহাস জানতেই হবে। এর মধ্যে জামাতিব্লগারদের মধ্যে আবির্ভাব হয় ত্রিভুজের। শুরুতে ওয়ালি, আস্তমেয়ে, ভুত ইত্যাদির দিকে মনোযোগ বেশি থাকায় সে তেমন নজরে পড়েনি। কিন্তু মার্চের শেষ থেকে সেই ক্রমশ সকলের নজর কেড়ে নিলো এই ব্লগারের লেখালেখি। মার্চের সেই সোনাঝরা পোস্টগুলি সে মুছে ফেললেও তার পুরনো ব্লগগুলিতে নজর দিলেই মন ভালো হয়ে যেত। কখনো ডারউইন, কখনো ধর্মতত্ত্ব, কখনো টেকমোল্লাবাদ নিয়ে তার প্রচুর জ্ঞানগর্ভ লেখা আর তাতে জামাতচক্রের মুর্হুমুহু সমর্থনে এপ্রিল নাগাদ সরাসরি জামাতশিবির পরিবারের সদস্যদের ছাড়িয়ে ত্রিভুজই হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্মে টেকমোল্লাবাদের আইকন। মে মাসের শুরুতে অমি রহমান পিয়াল প্রাপ্তি নামে ক্যান্সার আক্রান্ত একটি শিশুর চিকিৎসার জন্য ব্লগারদের সহায়তা কামনা করে একটি পোস্ট দেন। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে যার যার সামর্থ্যমতো চেষ্টা করতে থাকে। এই সময় দীক্ষক দ্রাবিড়ের এই পোস্টকে কেন্দ্র করে ত্রিভুজ ক্ষেপে ওঠে। একে গুতা দেয় তাকে গুতা দেয় পরিস্থিতি। তখন অরূপ এই ছবিটা তৈরি করে সমমনা ব্লগারদের শেয়ার করে। দুষ্টু ব্লগাররা এবার পালন করে রামছাগল দিবস। সেটা ছিল ২০০৬ সালের ২১ মে। ত্রিভুজ সেইসময়কার বেশিরভাগ পোস্টই মুছে ফেলেছে। শুধু এইটা অবশিষ্ট। ২১ মে ত্রিভুজগলে রামছাগলের মাথা বেরিয়ে আসার সেই ছবিটাই ছিল ত্রিভুজকে পঁচিয়ে করা রামছাগল দিবসের সবগুলি পোস্টের আইকন। সেখানে সমমনা ব্লগারদের প্রায় সবাই পোস্টালেও মুখফোড় লিখলেন না। পাঠকরা রীতিমতো অপেক্ষা করেছিল কিন্তু তার দেখা পাওয়া গেল না। তিনদিন পরে এই পোস্ট।। লেখাটায় তেমন মন্তব্য না থাকলেও "ছাগুরাম" শব্দটা ব্লগারদের মনে গেঁথে গেল। ৩১ মে মুখফোড় লেখেন প্রথম ছাগুরাম কাব্য।
তারপর দিন যায়। মাস যায়। ব্লগে লোক বাড়তে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের সাথে যোগ দেন কনফুসিয়াস,হাসিব(শুরু থেকেই ব্লগে থাকলেও লিখতে আর কমেন্ট করতে শুরু করে জুলাই-আগস্টের পরে), চোর, এস.এম. মাহবুব মুর্শেদ, গোপাল ভাড়, ঝরাপাতা, প্রজাপতি, অন্যমনস্ক শরৎ, হাসান মোরশেদ, আরিফ জেবতিক, নজমুল আলবাব, আনোয়ার সাদাত শিমুল, আরণ্যক সৌরভ, জামাল ভাস্কর, বাকী বিল্লাহ, রাকিব হাসনাত সুমন এবং আরো অনেকে। যোগ দেন মানে যোগ হতে থাকেন। সেটা ছিল ঝড়ের বেগে বাংলাব্লগের বেড়ে ওঠার সময়। রাজাকার পক্ষেও ফজলে এলাহী মুজাহিদ, আশরাফ রহমান, সাইমুম প্রমূখরা যোগ দেন। আরো নানান কথায় মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক আর বিরোধীদের লড়াই চলতেই থাকে। স্বভাবতই তর্কযুদ্ধে বিরোধীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সরাসরি জামাতি পোস্টের বদলে বিনোদোনমূলক নির্বুদ্ধিতাসম্পন্ন ডানপন্থী পোস্ট পড়তে থাকে রাজাকার পক্ষ থেকে। সেইসব বিনোদোনের স্রোতে ছাগুরাম থেকে কখন যে রামটা খসে গেল সেটা হলফ করে বলা মুশকিল। যে কোন ধর্মীয় মৌলবাদী, রাজাকারপন্থীই ছাগু বলে চিহ্নিত হতে থাকলেন। মৌলবাদ এবং রাজাকার প্রশ্নে "মধ্যপন্থা" অবলম্বনকারীরাও ব্লগারদের কাছে ছাগু বলে অভিহিত হতে থাকলেন।
তারপর চলে গেল অনেকগুলি বছর। ছাগুর সংজ্ঞার্থ তেমন আর বদলায় নাই। ২০০৮ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্লগাররা ছাগু বলতে সাধারণভাবে মৌলবাদী এবং বেইসবল ব্যাট হাতে শিম্পাঞ্জি বলতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী/সমর্থকদের বুঝতো। তারপর সময়ের সাথে ছাগু ছাড়া বাকি পরিভাষাগুলি হারিয়ে গেল। ফখরুদ্দীনের আমলে "নিরপেক্ষ" ভাব দেখানো ব্লগারদের সুশীল বলা শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তারা হয়ে যান সুশীল ছাগু। একইভাবে এসেছে বামছাগু, উত্তরাধুনিক ছাগু, আওয়ামীছাগু, কর্পোরেটছাগু এইসব টার্ম। অর্থাৎ যেখানেই যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের ধরণে ত্রিভুজের মেথাড পাওয়া গেছে সেখানেই ছাগু শব্দটা জুড়ে গেছে। সব ছাগুদেরই পলিটিক্যাল কেবলা কোন না কোনভাবে চাঁদতারাতে গিয়ে মিশেছে।
এই হল মোটের উপর বাংলাব্লগে "ছাগু" শব্দের ইতিহাস। এর সাথে আরো অনেক তথ্য যোগ হতেই পারে। কিন্তু মূল ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত যা লিখলাম ঠিক তাই। এর মধ্যে বাইরে থেকে কোন অবান্তর উপাদান সংযোজন ইতিহাস বিকৃতি বলে ধরা হবে। ২০০৬ এর পরে ব্লগ লিখতে শুরু করা কেউ ছাগুনাম ইতিহাস লিখতে গেলে কোন অবস্থাতেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখতে পারবেন না।


5 comments:

Unknown said...

হু !
Tender business bangladesh dhaka bid auction purchase sales bangla.

Unknown said...

ভাই আর যাই হোক শিরোনামটা সত্যি দারুন হয়েছে। ভাল লাগল

Unknown said...

Thanks a lot for taking the time to share your experiences with so much detail. It’s clear and up to the point, full of real life examples. I do not offer any type, I think this information will be useful Rent Flat

Unknown said...

ধন্যবাদ, অনেক কিছু জানার ছিল। আমরা অনেকে অনেক কিছুই জানি না। আপনা এই পোস্টটি দ্বারা অনেকে কিছু তথ্য জানতে পারবে।আমি আপনাকে কোন প্রকার অফার করছি না। ছোট একটি তথ্য আপনার উপকারে আসতে পারে house rent in dhaka mohammadpur

Kafy said...
This comment has been removed by the author.