এরপর বহুদিন যাওয়া হয়নি নানা ঝামেলায়। ঐ ক্নাইপের উল্টোদিকে এক বন্ধু থাকতো। ২০০৬ এর শুরুতে সে কাসেল ছাড়লে ঐ পাড়ায় যাওয়া বন্ধই হয়ে গেল একরকম। মাঝে মধ্যে লিডলে (সুপারমার্কেট) যাবার পথে কৌতুহলি উঁকি দিতাম। ২০০৬ এর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে, সামার ভ্যাকেশান তখন প্রায় শেষ, দিন ছোট হতে শুরু করেছে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটতে হাটতে এসে দাড়ালাম সেই ক্নাইপের সামনে।
সাইনবোর্ডে বানান আর ব্যাকরণের ভুল শুধরে করা হয়েছে “ডি এক্ ক্নাইপে”। বারে একাকি বসে ছিল মালিকের অতিকায় কন্যা সাব্রিনা। আমাকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলো। বলে , “তোমারে রাস্তায় দেখি একা একা ঘুরতে অথচ এইখানে আসো না । ভাবলাম বুঝি বিয়া কইরা সাত্বিক হৈয়া গেছ”। বলে রীতিমতো সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে হাসি। আমিও একটা অট্টহাসি দিলাম। তারপর বারের ওপাশে গিয়ে বললো, “এই নাও তোমার আজকের প্রথম পেগ আমিই খাওয়াই”। বল্লাম, খাইছে! ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো ,মানে? বল্লাম, হেহে ধন্যবাদ।
চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্রুনির খবর কি? কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ভালোই মনে হয়। কাসেল ছাড়ছে ছয় মাস হৈয়া গেল। তারপর চোখ নামিয়ে বাকির খাতায় মন দিল। প্রতিবেশী বুড়োদের মধ্যে অনেকেরই বাকি খাবার বাতিক আছে। বুঝলাম ওরা আর একসাথে নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম গোপনে। ব্রুনিকে চিনতাম কাসেলে পা দেবার প্রথম সপ্তাহ থেকেই। ক্যাম্পাসে আড্ডা মারতো আর ভাল্ডাউ এর পলিটেকনিক স্কুলে কি যেন শিখতো। ব্রুনি আর সাব্রিনাকে একসাথে মনে হতো লরেল-হার্ডি। একবারে গ্রুন্ডশুলের( প্রাথমিক স্কুল) প্রেম। কতদিন রাত ১১টার দিকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুনছি মেনজার পিছনের পার্কে সাব্রিনার ঠা ঠা হাসি। গভির রাতে ঐ হাসিতে রীতিমতো ইকো সৃষ্টি হতো।
বাকির খাতায় টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পড়তেই টিস্যু এগিয়ে দিলাম। এর মধ্যে ফ্রাউ ভোলকপ্ফ এসে পড়লেন সেদিনের ডিউটিতে। তাকে ক্যাশ বুঝিয়ে সাব্রিনা বার থেকে বেরিয়ে এসে বললো, চলো ঐ দিকে গিয়া বসি। গেলাম। চোখে তখনো পানি। সাব্রিনা মেদ কমানোর লক্ষ্যে উত্তেজক পানীয় বাদ দেবার ঘোষনা দিলেও ওর জন্য একটা সাদা বীয়ার নিয়ে এলাম। আর নিজের জন্য একটা ডবল পেগ। ছেমড়ি শেকল পড়া দাঁত দেখিয়ে হাসে।
-জানো কোন রকম কোন ঝগড়া হয় নাই, কথা কাটাকাটি হয় নাই এমন কি কান্নাকাটিও হয় নাই। রীতিমতো একটা সৌজন্য সাক্ষাতের মতো। বিকাল ৪ টা ৩০ শে বাড ভিলহেল্মসহোয়ের একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে বইসা ছিল আমার জন্য। বরাবরের মতো আমি অর্ডার দিলাম স্পাগেটি আর ল্যাম্ব। সাথে ২০০৪ এর ল্যাম্বার্টি। খাইতে খাইতে অনেক হাসিহাসি করলাম। ত্রিশ বছর বয়সে নতুন কৈরা সিঙ্গেল হৈলে কি কি নতুন সম্ভাবনা তৈরী হৈতে পারে ইত্যাদি নানান কথায় সময় কাইটা গেল। সাতটা নাগাদ উঠলাম। বের হইয়া হাটতে হাটতে বানহফের (রেল স্টেশন) দিকে আসতে আমি থাকতে না পাইরা জড়াইয়া ধরলাম। ঐভাবে প্রায় ২০ মিনিট দাড়াইয়া ছিলাম ফুটপাথে। তারপর ও ডর্টমুন্ডের ট্রেন ধরলো আমি বাসায় ফিরলাম পায়ে হাইটা।- ডর্টমুন্ড?- হুম । ওইখানে চাকরি পাইছে একটা কাউফ হাউসে। লাগার ম্যানেজমেন্টে। ভালো পয়সা দিবে।-কিন্তু কেন? তুমি তো যাইতেই পারতা ওর সাথে...-গেলাম না! কাসেলে শিকড় গজাইয়া গেছে। আর ব্রুনির এক কাজিন থাকে ডর্টমুন্ডে...-লরা?-হ্যা। মনে আছে দেখি তোমার। ওর সাথে নাকি ইদানিং ভালোই বোঝাপড়া হইতেছে। আমিও কংগ্রাচুলেট করলাম। পুরনো কথা মনে রাইখা আর কি লাভ?
মনে পড়লো ২০০৪ এ কার্নিভালের সময় লরাকে চুমু খাওয়ার ইস্যুতে ব্রুনির সাথে ঝগড়া করে বোতলে হাতটাত কেটে কেলেঙ্কারি দশা। ২৫ দিনের মতো হাসপাতালে ছিল সাব্রিনা। ব্রুনি প্রায় সারাদিনই তখন পড়ে থাকতো হাসপাতালে।
ত্রিশ বছরের জীবনে ভাংচুর কম দেখি নি। বললাম, তুমি এখন কি করছ?- কি করবো? যা করছিলাম তাই। দুপুরে পাপা বাড়ি গেলে এখানে এসে বসি, তারপর ফ্রাউ ভোলকপ্ফ এলে তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে হয় একগাদা গিলি না হয় ফুলদার পাড়ে গিয়া বইসা থাকি। তারপর বেলা কইরা ঘুম থিকা উঠি। এইভাবে চলতেছে গত ছয় মাস। মাঝে মধ্যে বিলিয়ার্ড খেলি। এই ক্নাইপে ছাইড়া কই যাবো? এখানেই জন্ম থিকা আছি। এর মায়া ছাড়ি কেমনে?
বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম এই কথা গুলো। শেকড় ছিড়ে একটু খানি স্বচ্ছলতার লোভে বছরের পর বছর পড়ে আছি বিভুইয়ে। জীবিতও আছি জীববিজ্ঞানের অর্থে। চোখের সামনে সম্পর্কগুলোর মেটাবলিক ভাংচুর দেখছি। দেখেই যাচ্ছি। প্রেম, ক্যারিয়ার, রাজনীতি সবকিছুতে।
মোয়ন্শেবেয়ার্গার স্ট্রাসে পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে হঠাৎ করে ফেটে পড়লাম হাসিতে। রাস্তা এক্কেবারে ফাঁকা। চিৎকার করে বললাম, মর হালারা মাল খাইয়া মর !
সাইনবোর্ডে বানান আর ব্যাকরণের ভুল শুধরে করা হয়েছে “ডি এক্ ক্নাইপে”। বারে একাকি বসে ছিল মালিকের অতিকায় কন্যা সাব্রিনা। আমাকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলো। বলে , “তোমারে রাস্তায় দেখি একা একা ঘুরতে অথচ এইখানে আসো না । ভাবলাম বুঝি বিয়া কইরা সাত্বিক হৈয়া গেছ”। বলে রীতিমতো সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে হাসি। আমিও একটা অট্টহাসি দিলাম। তারপর বারের ওপাশে গিয়ে বললো, “এই নাও তোমার আজকের প্রথম পেগ আমিই খাওয়াই”। বল্লাম, খাইছে! ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো ,মানে? বল্লাম, হেহে ধন্যবাদ।
চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্রুনির খবর কি? কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ভালোই মনে হয়। কাসেল ছাড়ছে ছয় মাস হৈয়া গেল। তারপর চোখ নামিয়ে বাকির খাতায় মন দিল। প্রতিবেশী বুড়োদের মধ্যে অনেকেরই বাকি খাবার বাতিক আছে। বুঝলাম ওরা আর একসাথে নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম গোপনে। ব্রুনিকে চিনতাম কাসেলে পা দেবার প্রথম সপ্তাহ থেকেই। ক্যাম্পাসে আড্ডা মারতো আর ভাল্ডাউ এর পলিটেকনিক স্কুলে কি যেন শিখতো। ব্রুনি আর সাব্রিনাকে একসাথে মনে হতো লরেল-হার্ডি। একবারে গ্রুন্ডশুলের( প্রাথমিক স্কুল) প্রেম। কতদিন রাত ১১টার দিকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুনছি মেনজার পিছনের পার্কে সাব্রিনার ঠা ঠা হাসি। গভির রাতে ঐ হাসিতে রীতিমতো ইকো সৃষ্টি হতো।
বাকির খাতায় টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পড়তেই টিস্যু এগিয়ে দিলাম। এর মধ্যে ফ্রাউ ভোলকপ্ফ এসে পড়লেন সেদিনের ডিউটিতে। তাকে ক্যাশ বুঝিয়ে সাব্রিনা বার থেকে বেরিয়ে এসে বললো, চলো ঐ দিকে গিয়া বসি। গেলাম। চোখে তখনো পানি। সাব্রিনা মেদ কমানোর লক্ষ্যে উত্তেজক পানীয় বাদ দেবার ঘোষনা দিলেও ওর জন্য একটা সাদা বীয়ার নিয়ে এলাম। আর নিজের জন্য একটা ডবল পেগ। ছেমড়ি শেকল পড়া দাঁত দেখিয়ে হাসে।
-জানো কোন রকম কোন ঝগড়া হয় নাই, কথা কাটাকাটি হয় নাই এমন কি কান্নাকাটিও হয় নাই। রীতিমতো একটা সৌজন্য সাক্ষাতের মতো। বিকাল ৪ টা ৩০ শে বাড ভিলহেল্মসহোয়ের একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে বইসা ছিল আমার জন্য। বরাবরের মতো আমি অর্ডার দিলাম স্পাগেটি আর ল্যাম্ব। সাথে ২০০৪ এর ল্যাম্বার্টি। খাইতে খাইতে অনেক হাসিহাসি করলাম। ত্রিশ বছর বয়সে নতুন কৈরা সিঙ্গেল হৈলে কি কি নতুন সম্ভাবনা তৈরী হৈতে পারে ইত্যাদি নানান কথায় সময় কাইটা গেল। সাতটা নাগাদ উঠলাম। বের হইয়া হাটতে হাটতে বানহফের (রেল স্টেশন) দিকে আসতে আমি থাকতে না পাইরা জড়াইয়া ধরলাম। ঐভাবে প্রায় ২০ মিনিট দাড়াইয়া ছিলাম ফুটপাথে। তারপর ও ডর্টমুন্ডের ট্রেন ধরলো আমি বাসায় ফিরলাম পায়ে হাইটা।- ডর্টমুন্ড?- হুম । ওইখানে চাকরি পাইছে একটা কাউফ হাউসে। লাগার ম্যানেজমেন্টে। ভালো পয়সা দিবে।-কিন্তু কেন? তুমি তো যাইতেই পারতা ওর সাথে...-গেলাম না! কাসেলে শিকড় গজাইয়া গেছে। আর ব্রুনির এক কাজিন থাকে ডর্টমুন্ডে...-লরা?-হ্যা। মনে আছে দেখি তোমার। ওর সাথে নাকি ইদানিং ভালোই বোঝাপড়া হইতেছে। আমিও কংগ্রাচুলেট করলাম। পুরনো কথা মনে রাইখা আর কি লাভ?
মনে পড়লো ২০০৪ এ কার্নিভালের সময় লরাকে চুমু খাওয়ার ইস্যুতে ব্রুনির সাথে ঝগড়া করে বোতলে হাতটাত কেটে কেলেঙ্কারি দশা। ২৫ দিনের মতো হাসপাতালে ছিল সাব্রিনা। ব্রুনি প্রায় সারাদিনই তখন পড়ে থাকতো হাসপাতালে।
ত্রিশ বছরের জীবনে ভাংচুর কম দেখি নি। বললাম, তুমি এখন কি করছ?- কি করবো? যা করছিলাম তাই। দুপুরে পাপা বাড়ি গেলে এখানে এসে বসি, তারপর ফ্রাউ ভোলকপ্ফ এলে তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে হয় একগাদা গিলি না হয় ফুলদার পাড়ে গিয়া বইসা থাকি। তারপর বেলা কইরা ঘুম থিকা উঠি। এইভাবে চলতেছে গত ছয় মাস। মাঝে মধ্যে বিলিয়ার্ড খেলি। এই ক্নাইপে ছাইড়া কই যাবো? এখানেই জন্ম থিকা আছি। এর মায়া ছাড়ি কেমনে?
বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম এই কথা গুলো। শেকড় ছিড়ে একটু খানি স্বচ্ছলতার লোভে বছরের পর বছর পড়ে আছি বিভুইয়ে। জীবিতও আছি জীববিজ্ঞানের অর্থে। চোখের সামনে সম্পর্কগুলোর মেটাবলিক ভাংচুর দেখছি। দেখেই যাচ্ছি। প্রেম, ক্যারিয়ার, রাজনীতি সবকিছুতে।
মোয়ন্শেবেয়ার্গার স্ট্রাসে পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে হঠাৎ করে ফেটে পড়লাম হাসিতে। রাস্তা এক্কেবারে ফাঁকা। চিৎকার করে বললাম, মর হালারা মাল খাইয়া মর !
No comments:
Post a Comment