Sunday, August 17, 2008

রাজনৈতিক সংস্কার


রাজনৈতিক সংস্কারের হুজুগটা চাপা পড়েই গেলো শেষ পর্যন্ত। বিষয়টা যারা তুলেছিলেন তাঁরা সম্ভবত এই চাপা পড়বার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই মুখ খুলেছিলেন। প্রসঙ্গটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গীক ছিল না। যেমন নতুন ছিল না পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপোড়েনে উবে যাবার ঘটনাও। তবু সেটা উঠেছিল। ইউটিলিটির কারণেই উঠেছিল। বাজারে ন্যুনতম চাহিদা ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। রাজনীতির বাজারে ইস্যু খুব চড়া দামের পণ্য। এই পণ্য সরবরাহ করার আগে সঞ্চালককে সেই বাজারের আগাপাশতলা ব্যবচ্ছেদ করে পণ্যের উপযোগীতা এবং অবশ্যই পুনরুৎপাদনে উপযোগীতা বৃদ্ধির সম্ভাবনার সতর্ক পাঠ নিতে হয়। সুতরাং দৃশ্যত: ব্যর্থ হওয়া বা চাপা পড়া ইস্যুতে, এর দৃশ্যমান সঞ্চালককে ক্ষতিগ্রস্থ হতেই হবে এমন না।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি। অত্যন্ত জরুরি। এটা সমাজ বিশ্লেষকের চাইতে অনেক বেশি অনুভব করেন সমাজে বসবাসকারী মানুষ, বিশেষভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক মানুষ, রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ণে প্রকৃত আক্রান্ত মানুষ। তাঁদের এই অনুভব নির্বাচনী রাজনীতির পুঁথিগত সীমা পেরিয়ে আরো দীর্ঘদিনের। পরিভাষার কালোয়াতী দেখানো সংস্কারের ফাঁকও চট করে তাদেরই চোখে পড়ে। কার্ড শাফল করার মতো কিছুদিনের অভিনয় শেষে সংস্কার নাটকের অবসানের দৃশ্যেও তাঁরা ক্লান্ত। সেই লুহামানব আইয়ুব খানের আমল থেকে আজ পর্যন্ত এই বিরক্তিকর নাটকের পূনরাবৃত্তি দেখে মানুষ ক্লান্ত। এদিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায় গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের প্রশ্নে জনগণের ক্লান্তির পাল্লা খানিক কম ভারী। কারণ প্রতিটি উর্দিপরা ত্রাতার আগমণ গণপ্রতিনিধিত্বশীল অবকাঠামো নির্মাণকে একেকবারে কয়েক দশক করে পিছিয়ে দিয়েছে। প্রতিবারই ত্রাতারা তাঁদের শুভাগমনের দায় পূর্ববর্তী নির্বাচিত সরকার বা সরকারগুলির উপরে চাপিয়ে একেবারে স্টেরিও টাইপ কাজ করে যান। একেকবার তাঁরা একেকভাবে নানারকম সংস্কারের ধূয়া তোলেন। সেটা কখনো মৌলিক গণতন্ত্র, কখনো ১৯ দফা, কখনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ, কখনো রাজনৈতিক সংস্কার নামের কোন এক দুর্বোধ্য প্রপঞ্চ।

পৃথিবীর এই অঞ্চলে মোটাদাগে বলতে গেলে আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ শুরু ঔপনিবেশিক তত্ত্বাবধানে। বিষয়টি ভালো না মন্দ ছিল তার বিচার মুস্কিল। উপনিবেশ স্থাপনকারীরা উপনিবেশে যাই স্থাপন করেছেন তার সবটাই ঔপনিবেশিক লুঠপাট সহজতর করার উদ্দেশ্যে। সেসব ব্যবস্থার যা কিছু তর্কসাপেক্ষে জনগণের পক্ষে গেছে তার সবটাই ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতার নিয়মে। যেমন, রেলগাড়ী। লিভারপুল আর ম্যাঞ্চেস্টারে রেলগাড়ী চালু হবার বছর খানেকের মধ্যে সাহেবরা কলিকাতায় রেললাইন পাতেন লুঠের মাল দ্রুত পাচারের উদ্দেশ্যে। তার অ্যান্টি-থিসিসে জনগণ পায় যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মতো বিষয়ে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সেটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে সিভিল সার্ভিস পেরিয়ে একসময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পর্যন্ত আসে। সাহেবভক্তদের চাকফিব্র্যান্ডি খাবার ক্লাব থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হতে তাঁকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। এক স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই তাকে কয়েক দফা ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক ভিত্তি পেকে উঠলে তার ফসল ঘরে তুলতে সাহেবরা মুসলীম লীগ নামে আরো একখানা দল তৈরী করেন। দুটোর কোনটাই তাঁর ঔপনিবেশিক দাস মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আজকের বাংলাদেশে, বলতে গেলে শুধু বাংলাদেশে না সাবেক বৃটিশ ভারতের প্রায় সর্বত্রই যে রাজনৈতিক দলগুলি রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে সেগুলি কোন না কোনভাবে কংগ্রেস-মুসলীম লীগের বিভিন্ন রূপান্তর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মাউন্টব্যাটেন সাহেব ব্যাটন বগলে ফেরত গেলেও রেখে গিয়েছিলেন তাঁদের মরতে দম অনুগত প্রশাসন আর এই দুইখানা মৌলিক হাঁটুভাঙ্গা দল। বাকিসব উপনিবেশের মতো এখানেও প্রশাসনের আমলাতান্ত্রিক অবকাঠামো বিকশিত করা হয়েছে রাজনৈতিক অবকাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যহীনভাবে।

১৯৪৭ এর পরে ভাঙা টুকরো গুলির বিকাশ স্বতন্ত্র পথে চলে যায়। ভারতে নিজস্ব অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ন্যুনতম বিকাশ ঘটায় সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি নিজেকে একভাবে গড়ে নিয়েছে। পাকিস্তানে আর পরে স্বাধীন বাংলাদেশে এর প্রবণতা একতরফা নিম্নগামী। এখানে কাগজে কলমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান হলেও বাস্তবে শিল্পায়ন, ভূমি সংস্কার কোনটাই হয়নি। একদিকে ভূমিহীন কৃষকরা জ্যামিতিক হারে সংখ্যায় বেড়েছে অন্যদিকে ইংরেজের তৈরী রাজনৈতিক শ্রেণী নানাভাবে খোলস বদলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে। তাঁদের এই কর্তৃত্ব হাতে থাকার সাথে নির্বাচিত সরকার বা জলপাই সরকার থাকা না থাকার কোন সম্পর্ক নেই। বলা যায় এই কর্তৃত্বকে জোরদার করতে নির্বাচিত অনির্বাচিত দুই প্রকার সরকারই একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে গেছে। এই কাজ করতে তাঁদেরকে উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের অভিজ্ঞতার যতটুকু ইতিবাচক উপাদান এই দলগুলি অর্জন করেছিল তাঁকে কখনো সরাসরি আক্রমণ কখনো স্লো-পয়জনিঙের মাধ্যমে নি:শেষিত করতে হয়েছে। আওয়ামী লিগের কথা বলা যায় এই প্রসঙ্গে। এই দলটির জন্ম ঔপনিবেশিক তত্বাবধানে না হলেও ঐতিহাসিকভাবে তা মুসলীম লীগের গর্ভ থেকে আগত। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৯৬৮-৬৯ এ নিহত গরুচোরদের জাতভাইরা জৈবিক নিয়মেই এই দলটিতে বাস্তব রাজনৈতিক খুঁটি হিসেবে কাজ করেছে, যারা স্বাধীনতার পরে কার্যকর রাজনৈতিক শ্রেণী হিসেবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টতর করেন। রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নেওয়া জনগণ আর তাঁর নেতৃত্বে থাকা রাজনৈতিক দলের গাঠনিক উপাদানের মধ্যকার দূরত্ব দৃশ্যত অনতিক্রম্যই থেকে গেছে। এর পরে যতবার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর হয়েছে তাতে প্রতিবারে আরো বেশী করে লুম্পেনাইজেশান ছাড়া আর কিছু ঘটেনি।

রাজনৈতিক সংস্কার বলতে বাস্তবে কোন কিছু করতে হলে শুধু দলের ভেতরে গণতন্ত্র আর নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতায় নানারকম ইচিং বিচিং পরিবর্তন করা অর্থহীন। খতিয়ে দেখতে হবে দলের ভেতরে গণতন্ত্রের যে অবকাঠামোওয়ালা গঠণতন্ত্র নিয়ে একেকটা দল যাত্রা শুরু করেছিল কী কারণে তা ক্রমশ অকার্যকর হয়ে লুম্পেনদের অলিগার্কিতে পরিণত হয়েছে।

সংস্কারের জন্য সবচাইতে জরুরি হচ্ছে রাজনৈতিক দলের মাইক্রোপলিটিক্যাল স্ট্রাকচার। সেখান থেকে কারা কিভাবে রাজনীতিতে রিক্রুট হচ্ছেন। এই রিক্রুটমেন্টের প্রক্রিয়াতে বাস্তব পরিবর্তন আনা সম্ভব না হলে বাকি সবকিছুই বাখোয়াজ থেকে যাবে।

রাজনৈতিক দলে রিক্রুটমেন্ট হয় ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক আর বিভিন্ন পেশাজীবিদের মধ্য থেকে। এর সব কয়টিরই অস্তিত্ব যখন বৃটিশ বিদায় হয়ে ভারত-পাকিস্থানের জন্ম হয় তখন ছিল। তারপর একটা একটা করে সেগুলিকে অকার্যকর করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ধ্বংশ করা হয়েছে ট্রেডইউনিয়নগুলি তারপর ছাত্র রাজনীতি তারপর সেই সূত্রে পেশাজীবি সংগঠণগুলি। রাজনৈতিক সংস্কার করতে গেলে এদের পুনরুদ্ধার নয়, নতুন করে এই প্রতিষ্ঠানগুলি নির্মান করতে হবে। অথচ রাজনৈতিক সংস্কারের মুখপাত্ররা সবাই ব্যতিক্রমহীনভাবে এদেরকে কিভাবে আরো বেশী করে অ্যাপলিটিকাইড করা যায় সেখানে মন দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন। মূখ্যত: ক্ষমতার দ্বন্দ্বে থাকা রাজনৈতিক দলগুলির ছাত্র সংগঠণের নৈতিক মৃত্যু, তথাকথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে রাজনীতি সম্পর্কে খুব সাফল্যের সাথে উন্নাসিক করে তুলেছে। সর্বত্রই পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে মুখচেনা চোরছ্যাচ্চর না হলে কেউ আর রাজনীতিতে শাইন করতে পারে না। মাইক্রোপর্যায়ে এই রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে যে চেহারা দেখাবার তাই দেখাচ্ছে।

অথচ অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। অনেক বড় এলাকা নিয়ে ঘুরছে। এলাকাটা এতোই বড় যে, ঘুর্ণনের ফজিলত বরাবরের মতোই সীমানা পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। এই যাওয়ার কাজে বর্তমান রিক্রুটমেন্টরা কখনো হাঁটুর উপর সাদা লুঙ্গী তুলে কখনো কোটপ্যান্ট পড়ে অনেক ইংরেজী বুকনি সহকারে মরতে দম সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন। চাকা যেহেতু ঘুরছে সুতরাং ফজিলতপ্রাপ্তরা কর্মচারী পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন বোধ করছেন না, বরং কিভাবে আরো বেশী করে আরো অনুগত এবং দক্ষ তস্করদের রাজনীতির মঞ্চে আগমণ ঘটানো যায় তার ব্যবস্থাপত্রে উৎসাহিত হচ্ছেন।

রোগ নির্ণয় ছাড়া চিকিৎসা শুধুমাত্র কিছু কিছু মারফতি লাইনে সম্ভব। তাছাড়া রোগের বৃত্তান্ত না জানলে রোগের জটিলতাও বাড়তে থাকে। তখন উপশমের জন্য পুরনো মাদকদ্রব্যের ক্রেডিবিলিটিও কমতে কমতে তলানিতে চলে আসে। যাদুর জামা দেখানোকে উপশমের প্রকৃষ্টতম পথ বলে রবার্ট ম্যাকনামারা, শিকাগো বয়েজ, বুড়ি থ্যাচার, তাড়কা যোদ্ধা রিগ্যানচক্র বহু অর্থশক্তিব্যায়ে প্রচার করেছেন, করে চলেছেন। তাঁদের জন্য এক্ষেত্রে একটাই আপাত: দু:সংবাদ হচ্ছে অতিব্যবহারে সম্প্রতি এই মাদকের পিনিক ছুটে গেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে তাঁদের সামনে রাস্তা দুটো। এক হচ্ছে অবিলম্বে নতুন মাদকের সন্ধান, দুই সমস্যার গোড়ায় অন্তত খানিকটা হলেও সংস্কার। এর বাইরে যারা চাকাটাকে জনগণের আওতায় ঘোরাতে চায়, তাঁদের দিকে কর্তব্য হচ্ছে যে করেই হোক প্রথমত গণপ্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা সচল রাখা আর দ্বিতীয়ত: এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে রাজনীতির মাইক্রো পর্যায়ে সংস্কারে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা। কাজটা জনগণকেই করতে হবে। জনগণ লড়তে লড়তে ক্লান্ত হলেও তাঁর সামনে থিতু হবার কোন পথ ইতিহাস রাখেনি।

No comments: