Wednesday, September 10, 2008

নিয়মিত লেখা আর ব্লগের লেখা ৪

ব্লগিঙের একেবারে শুরু থেকেই একটা প্রশ্ন পৃথিবীর সব ভাষাভাষী ব্লগ পাটাতনগুলিতে আলোচিত হয়ে এসেছে। ঠিক কোন ধরণের লেখাকে ব্লগ বলা যায়, কিংবা কী ধরণের লেখা ব্লগে লেখা উচিত। গত আট-নয় বছরের ব্লগিঙের ইতিহাসে দেখা গেছে শেষ পর্যন্ত ব্লগে কী লিখিত হবে না হবে, ব্লগাররা সেই বিষয়ে কোন ধরণের প্রাতিষ্ঠাণিক ট্যাগিং মেনে নেন নি। ছাপা মাধ্যমে বা আরো খানিক রঙ চড়িয়ে মেইনস্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়াতে যা যা ছাপা হয় ব্লগ শেষ পর্যন্ত তার সবটাই ধারণ করেছে। পার্থক্যটা তাহলে কোথায়? একটা পার্থক্য মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যে ব্লগারদের পারস্পরিক আদান-প্রদানে, আর খুব বড় আরো একটা পার্থক্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ছাপা মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সম্পাদককূলের আজ্ঞাভাজন [b][i]প্রতিষ্ঠিত[/i][/b] লেখককূলের বাইরে আরো কিছু লোকের লেখনি সক্রিয় হওয়া। ছাপা মাধ্যম লেখালেখির জগতে মনোপলি থাকা কালে প্রতিষ্ঠিত সম্পাদকগণের দুর্লঙ্ঘ ছাঁকুনি অথবা জীবনের নানান চড়াই-উৎড়াই অথবা যারা হয়তো তারুণ্যের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেখালেখির চিন্তাও করেননি ব্লগিং জমানার প্রথম দশকে প্রধাণত তাঁরাই লেখক হিসেবে উঠে আসছেন। তাঁদের লেখাতে, প্রকাশে এমন কোন কিছু থাকছে যা প্রতিষ্ঠিত ভারী ভারী লেখকের কাজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লেখাগুলি মানোত্তীর্ণ বা উপাদেয় নয় এমনটাও বলা যাচ্ছে না, কারণ সেক্ষেত্রে ব্লগিঙের জগত এভাবে বিস্তৃত হতো না। পাটাতন নির্বিশেষে ব্লগিং বিষয়ক সাধারণ নর্ম তৈরীর ব্যাপারে মূলধারার লেখক সম্পাদকদের তরফ থেকে ব্লগ জগতের একেবারে শুরু থেকে একটা চাপ কাজ করেছে। এটা আমার ব্যক্তিগত মতে তাঁরা করেছেন দীর্ঘ আধিপত্যের ভিত্তি নড়ে ওঠায়। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, ব্লগ শুধু যে নতুন পাঠক তৈরী করবে তাই না, নিয়মিত পাঠকদের মধ্যেও বিভাজন তৈরী করবে বা আরো স্পষ্ট বলতে গেলে পাঠ নামের প্রক্রিয়াটিই বিভাজিত হবে। তাঁদের এই আতঙ্কে বারুদ ছড়িয়ে নেট ব্যবহারকারী আর সেইসূত্রে ব্লগপাঠকের সংখ্যা দুটোই প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে বিস্তৃত হচ্ছে।


পশ্চিমে এই সঙ্কট যথারীতি বাংলাব্লগের জন্মের আগে দেখা দিয়েছে। সেখানে মূলধারার ছাপামাধ্যমগুলি, বিশেষত সংবাদমাধ্যমগুলি পাঠকের অনলাইন প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। ব্লগের সাথে মূলধারার মাধ্যমের নানারকম বিনিময়ের মাধ্যমে এক ধরণের ভারসাম্য তৈরীর প্রচেষ্টা দেখা গেছে। তাতে দুই মাধ্যমের বিরোধ দৃশ্যত: কমতিতে থাকলেও, টিউশন ফী বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, লক আউট বিরোধী শ্রমিক আন্দোলন, বিশ্বায়ন বিরোধী বিক্ষোভ ইত্যাদি বৃহত্তর গণসংযোগের ক্ষেত্রে ব্লগপাটাতনগুলি অন্তত ইউরোপে নতুন মাত্রার মৌলিক গণমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ব্লগ নামের এই নতুন মাধ্যমটির আত্মপ্রকাশ অবশ্যই কর্পোরেট বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন কোন উত্তরাধুনিক প্রপঞ্চ নয়, আমার ব্যক্তিগত মতে কর্পোরেট মাধ্যমের সাথে এর সম্পর্ক সমান্তরালও নয়। এই সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। প্রযুক্তি বিশ্বের নিয়ন্ত্রক মহোদয়গণ এই দ্বন্দ্বকে কব্জা করার ভাবনা শুরু থেকেই মাথায় রেখেছেন। তাঁরা সমাজবিজ্ঞানের এইসব আবঝাব ঝকমারি এড়াতে শুরুতেই প্রযুক্তির দিকটা নিজেদের পকেটে পুরে রেখেছেন। পশ্চিমে একে চ্যালেঞ্জ করে পুঁজির দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে বা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।

বাংলা ব্লগিঙের শুরু সব রকম বিতর্ক এড়িয়ে মেরে কেটে বলা যেতে পারে ২০০৩ সালে ইউনিকোড বাংলার জন্মের সময় থেকে। ( যদিও ২০০৩ সালের কোন রেফারেন্স নেটে পাইনি ) সেইসময় বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের অল্প কিছু লোক ব্লগস্পটে টুকটাক পোস্ট করতো। বাংলায় টাইপ করতে পারাটাই তখন একটা বিষ্ময়ের ব্যাপার ছিল। ২০০৩ কে বাংলা ব্লগিঙের শুরু বলে ধরে নেওয়াটা সেক্ষেত্রে নিতান্তই তর্কের খাতিরে। ( এই পর্যবেক্ষণ ব্যক্তিগত, তবুও আশা করি রেজওয়ান ভাইয়ের মতো ব্লগবিশেষজ্ঞদের সমর্থন পাবো :D) আমি বাংলা ব্লগিঙের শুরু বলে ধরতে চাই ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সামহোয়ারইনব্লগের জন্মকে। ইউনিকোডের তৎকালীন ঝামেলা এড়িয়ে সরাসরি বিজয়ে টাইপ করে ধুমধাম ব্লগিঙের আগাগোড়া বাংলায় প্রথম প্লাটফর্ম তৈরীর কৃতিত্ব তাদের। বাংলা ব্লগাবর্তের প্রথম ব্লগাররাও তৈরী হয় তাঁদের প্লাটফর্মকে ভিত্তি করে। এর দেড় বছর পরে আসে সচলায়তন আর প্যাচালী, আড়াই বছর পরে আমারব্লগ। এখন আরো বেশ কিছু নতুন ব্লগের জন্মের সম্ভাবনা বাতাসে ভাসছে। অর্থাৎ বাংলা ব্লগাবর্ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজির আওয়ায় এবং আওতা বহির্ভূত দুইভাবেই হচ্ছে। ব্লগের লেখকরা শুরু থেকেই ভৌগলিক সীমাবদ্ধতার বাইরে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেখতে গেলে তথ্যপ্রযুক্তির আওতাভুক্ত কোন কিছুরই কার্যত: ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা নেই। এখানকার সব কিছু শুরু থেকেই জাতীয়তা বা আন্তর্জাতিকতাকে ছাপিয়ে বৈশ্বিক। সুতরাং গ্লোবাল পলিটিক্যাল ইকোনমির সবধরণের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষকে ব্লগমাধ্যম জন্মসূত্রে ধারণ করে। কোন বিশেষ ভাষাভাষী ব্লগকে এই বৈশ্বিকতা থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করা সম্ভব নয়।

আমার ব্যক্তিগত মতে বৈশ্বিকতার এই মূলগত উপাদানই ব্লগ জগতে বিষয়বৈচিত্র্যের কারণ। ব্লগজগতে এই বৈচিত্র্য আমি বলবো বিষয়ে নয় প্রকাশে। আটপৌরে থেকে প্রমিত ভাষার উন্মুক্ত ব্যবহার (অ-ব্লগীয় মাধ্যমের ভাষায় "যথেচ্ছ ব্যবহার"), অন্তর্জালে প্রাপ্য তথ্যসূত্র উল্লেখে বিশেষ প্রযুক্তি সুবিধার মতো বিষয়গুলি ব্লগের আলোচনা-সম্পূরক আলোচনা-তর্ক-বিতর্ককে আলাদা একটা মাত্রায় নিয়ে গেছে। এই নতুন মাত্রা ব্লগের লেখকদের সাথে সাথে ব্লগ পাঠকদেরকেও ব্লগ পূর্ববর্তী পাঠ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে। এই পরিবর্তন যে ডায়নামিজম সৃষ্টি করেছে তা লেখক পাঠকের মধ্যকার দূরত্বকে, ইতিহাসের সম্ভবত হ্রস্বতম পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। অক্ষরজ্ঞানের সাথে অন্তর্জাল ব্যবহারের ন্যুনতম প্রযুক্তিজ্ঞান আছে এমন যে কোন ব্যক্তিই ব্লগ জগতে একাধারে লেখক এবং পাঠক। লেখক-পাঠক খুব কাছাকাছি এসে পড়ার প্রতিক্রিয়া দুই তরফেই নতুন কিছু অভিজ্ঞতার আর তা থেকে নতুন কিছু নর্মের ভিত্তি তৈরী করছে। একদিকে যেমন মূলধারার উন্নাসিক লেখক ব্লগজগতে এসে, তাঁদের ভাষায় অসংস্কৃত পাঠকের তরল মন্তব্য, অনভিপ্রেত আক্রমণ ইত্যাদির মুখে পড়েন, অন্যদিকে অনেক তথাকথিত তরল ব্লগারও ব্লগ পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে পূর্ববর্তী অনেক অজ্ঞানতা আর তৎজনিত সরলীকরণ থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পান। জাঁদরেল প্রফেসরকে ক্লাসে বা সেমিনারে করতে না পারা অনেক প্রশ্নই [b][i]অ্যাক্টিভ কালচারের[/i] [/b] তীব্রতা নিয়ে একজন অসংস্কৃত ব্লগার, বাস্তব জীবনের কোন প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানবাহককে করতে পারেন। এখানে প্রফেসর আর ছাত্র দুজনেই [b][i]টেক্সচুয়াল কালচারের[/i][/b] বাইরে অধিষ্ঠাণ করেন।

এই পয়েন্টে তর্ক তুলতে পারেন যোগাযোগ সমাজতত্ত্বের (communication sociology) অধ্যাপক। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারেন, নেট জগতের, তাঁর ভাষায়, এই নৈরাজ্য কি আসলে বিশ্বব্যপী ছাগলায়ন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করছে না? এখানকার এখন পর্যন্ত বেশীরভাগ লেখালেখিতে প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র থাকে না, থাকলেও তার আওতা নেটে প্রাপ্য সূত্রগুলিতে সীমাবদ্ধ। নেট জগতে প্রচুর রিসোর্স গত দেড় দশকে যোগ হলেও তা এখনো নিজেকে জনগণের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি ইত্যাদি।

আমি তাঁর সাথে দ্বিমত করবো। আমি বলবো ব্লগ নামের এই নতুন মাধ্যম, মধ্য নব্বুই এর আইটি ব্যুম যে ছাগলায়নকে রাজনৈতিকভাবে উৎসাহিত করেছিল, তার মুখে ছাই দেবার ক্ষমতা ধারণ করে। এই আপাত: নৈরাজ্যিক স্বাধীনতার সুযোগে, শুরুতে ছাগল গলা উঁচু করার মওকা পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ঠিক এই স্বাধীনতা ব্যবহার করেই শুধু ব্যক্তিছাগল না তাবৎ ছাগলায়ন প্রক্রিয়ার শ্রাদ্ধ করা সম্ভব। রিসোর্স প্রসঙ্গে বলবো, নেট জগতের বয়স তো মোটের উপর দেড় বা সাহেবদের হিসেবে মেরে কেটে দু'দশক মাত্র। রিসোর্স বাড়ছে প্রতিদিন এবং বাড়তেই থাকবে। এই বিষয়ে অভিযোগকারীর কর্তব্য নেট জগতকে সমৃদ্ধ করতে নিজে এগিয়ে এসে অবদান রাখা এবং একই সাথে মূল্যবান সময় থেকে খানিক খরচ করে নেটে আসলে কী কী পাওয়া যায় সেই সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিয়ে অভিযোগ করা। সোজা কথায় নেট জগতের পুরোটাই অ্যাক্টিভিজম। ব্লগ সেই অ্যাক্টিভিজমের সব থেকে কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম। এই যোগাযোগ কখনো কবিতায়, কখনো কথাসাহিত্যে, কখনো প্রবন্ধে, রম্য রচনায়, চুটকিতে, কখনো বা নিপাট সংবাদে ঘটতে থাকে। নির্দিষ্ট করে গায়ে সীল চড়িয়ে ব্লগের লেখা বলে কিছু নেই। ব্লগ একটা আলাদা মাত্রার মাধ্যম, যা নিজস্ব ধরণের লেখার সাথে সাথে অভ্যস্ত মাধ্যমের প্রচলিত লেখাগুলিকেও নতুন মাত্রাতে তুলে গ্রাস করে ফেলছে।


ভিভা ব্লগিং !

1 comment:

Addabaj said...

আমার মনে হয় ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় হবে লেখালেখির বড়ো মাধ্যম। কাগজে বইয়ের দিন শেষ হয়ে আসছে। চলুক কলম কী বোর্ডে।