Thursday, May 07, 2009

আম কোয়নিগস্ প্লাৎস্ :::: ৯

- নয়টা সাতাইশ।
মোবাইলের ঘড়ি দেখে মাকসুদ জানালো।
- আমার মনে হয়...
আরেকটা বীয়ার খুলতে খুলতে সোহাগ বলে,
- আমরা আপাতত সময় গোনা বাদ দেই। বীয়ার আছে আর ছয়টা। ওগুলা শেষ হওয়া পর্যন্ত যেই কয় পর্ব বানাইতে পারি বানাই। তারপর বাইরে গিয়ে ড্যোনারফোনার কিনা আনুমনে .... নাইলে ঘরে ডিমডুম দিয়া কিছু এক্টা করা যাইবো।
- ওকিডোকি। তবে আমি ভাবতেছিলাম অন্যকথা। একটা জার্মান গান যেইটা আমরা গাইতাম এইখানে আসার পর পর ইন্টারন্যাশনাল পার্টিতে আর পিওর জার্মানগো লগে পার্টি করার সময়...
- ভাস ভলেন ভিয়ার ট্রিঙ্কেন সীবেন টাগে লাঙ?
- গেনাউ ( এগজ্যাক্টলী) ..তবে সাথের ছবিগুলার ব্যাপারে আরো কয়েক পর্ব পার কইরা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাইবো। বেশীরভাগ চরিত্র চইলা আসছে। কিন্তু এখনো তাগো পরিচিতিটা ঠিকঠাক মতো আসে নাই।
- তাইলে টাইটেল মিউজিকটাও আরো কয়েক পর্ব পরে লাগাইস। এখন টাইম না খাইয়া লাগা তৃতীয় পর্ব।
- ওকে


তৃতীয় পর্ব


(প্রথম দৃশ্য)

কাসেল ভিলহেল্মসহোয়ে

তিন নম্বর প্লাটফর্মে স্মোকারস জোনে ধাতব ছাইদানের সামনে চুপচাপ বিড়ি খায় মকবুল আর জসীম। প্লাটফর্মের যে অংশে ওরা দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিমে অনেকদুর গিয়ে প্লাটফর্ম ফুরিয়েছে। গ্রীষ্মকালের শেষবেলার পড়ন্ত রোদ রেললাইন থেকে ঠিকরে চোখে লাগলেও একরকম আরামই লাগছে। রেল লাইনের ধাতব কিনারার দিকে টানা তাকিয়ে থাকলে একধরণের গতি অনুভব করা যায়। এই রেললাইন ধরেই মকবুল, জসীমসহ বাকি সবাই কাসেল শহরে প্রবেশ করেছে। যারা চলে গেছে তারাও কমবেশী এই রেললাইনের উপর দিয়েই গড়িয়ে গেছে।

-ধুরো বাল আরো দশ মিনিট...
- তাই নাকি?
- ঐ দেখ বোর্ডে লেখা উঠছে ...সিরকা সেন মিনুটেন ফেরস্পেটেড (প্রায় দশ মিনিট বিলম্বিত)
- চল কফি মাইরা আসি

দুজনে উপরে উঠে আসে ম্যাগডোনাল্ডসের দিকে। এক ইউরোর কফি/কাপুচিনোর আনগেবট (অফার) চলছে। কফির কোয়ালিটি ধুনফুন। তবুও স্টেশন এলাকায় এটাই সব থেকে সস্তা। আগে কফি মেশিনে ৫৫ সেন্টের কফি পাওয়া যেত। কোন অজ্ঞাত কারণে সেই যন্ত্র বছরখানেক ধরে নষ্ট। হয়তো ম্যাগডোনাল্ডস আর বড় কফিশপগুলির কৃপায়।

- কুতুব মিয়ারে কয়দিন রাখবি তোর বাসায়? প্লাটফর্মের দিকে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করে মকবুল।
- দুই দিনের বেশী না। পোলা সীট লইয়া আইতাছে। সোমবার দুপুরে হলে উইঠা যাইবো।
- লাকি চ্যাপ...
- আমি যেইবার আসলাম সেইবার কোথাও কোন সীট নাই। এমন কি প্রাইভেট বাসা পাওয়াও কঠিন ছিল। ছয়দিন ছিলাম ইয়ুথ হোস্টেলে। পুরা ১২০ টাকা নগদে ধরা।
- টেকা না ব্যাটা ইউরো ক
- আরে এখন আর ঐসব ফিলিংস নাই। একটানা অভাবে থাকতে থাকতে একরকম নিস্পৃহভাব তৈরী হৈয়া গেছে। প্রথম প্রথম প্রতিটা বিল টাকায় কনভার্ট করতাম। কইরা ডরে কানতাম। এই ফিলিংসটা মনে হয় কামলা দিতে দিতে নষ্ট হয়।
- হ। ঐ ফিলিংস আবার ফেরত আইবো কোনদিন চাকরি বাকরি পাইয়া দেশে টেকা পাঠাইতে গেলে..
- কি জানি?.....

সংলাপ চলতে চলতে ক্যামেরা প্লাটফর্ম ধরে এগোতে এগোতে ক্লোজ শটে রেললাইনের উপর দিয়ে চলতে থাকবে......

(দ্বিতীয় দৃশ্য)

চলন্ত ট্রেনে গতির বিপরীতে হাঁটা এমনিতেই কঠিন। তার উপর যদি হাতে কানায় কানায় ভরা কফির গ্লাস থাকে তো ষোলকলা। উহু পনের কলা। ষোলকলা পূর্ণ হলো ট্রেন খানিক ঝাঁকি খাওয়ায়। কফি ছলকে পড়লো কালো টিশার্টের জাগামতো। তাও আবার ফিরতি পথে কুতুবের সেই স্যুটকেসের সামনে। ষোল দশমিক এক পাঁচ কলা বলা যেতে পারে। কুতবের চোখে ফুর্তির ঝলক। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত কাঁথা পুঁড়ে আজ কিছুক্ষণ পর পরই ফুর্তির ডেগচিতে বলগ আসছে। ছেমড়ির গেঞ্জির রং নীল হলে নজরুলকে স্মরণ করা যেতো। ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের কালোয়াতি মনে পড়ে,

নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে
নীল যমুনায়
কে যায়...............
...................
কলসে কঙ্কণে রিনিঝিনি ঝলকে
চমকায় উন্মন...ইত্যাদি। কিন্তু কোথায় যমুনা কোথায় কঙ্কণ কোথায় কলস কোথায় নিলাম্বরী...সামনে দাঁড়িয়ে কালো টিশার্ট পড়ে উত্তেজিত বাদামী বালিকা....

কফি ছলকে গেঞ্জিতে পড়তেই শারমিন ধমকে ওঠে...
- বাল !
- য়ূ ক্যান সিট হিয়ার..সামনের সিট থেকে ব্যাগ সরিয়ে কুতুব ভদ্রভাবে বলে। যদিও নারী কণ্ঠে বাল শুনে এখন হৃদয়ে নতুন পিনিক। "বাল"এর কৃপায় ছেমড়ি ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে তার জাতীয়তা। যতটা সম্ভব চোখমুখ থেকে সেই অনুভব আড়াল করে কুতুব ভদ্রতা অব্যহত রাখে,
- প্লিজ টেক আ সিট। ইটস ওকে...
- থ্যাংকস....শারমিনের গলায় পরাজয়ের আভাস। চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কফিতে মন দেয়। বাইরের দৃশ্যাবলী অনড়। কারণ ঐ ঝাঁকির পরে ট্রেন থেমে আছে। অ্যানাউন্স হলো লাইনে খরগোশ না কিজানি এক্টা কাটা পড়েছে, মিনিট দশেক দেরী হবে।

কুতুব কায়দা করে নিজের নিচের ঠোট কামড়ে ধরে। ছেমড়িতো দেখা যায় চুড়ান্ত অভদ্র। খাড়াইতে পারতেছিল না ভদ্রতা কইরা বইতে দিলাম..আর এখন একটা কথাও কয় না....কাসেলে গিয়া লই। বুঝবি...আবার নজরুলেক মনে পড়ে....বুঝবে সেদিন বুঝবে...কফি শেষ করে শারমিন আবারো ঝটপট উঠে নিজের সীটের দিকে চলে যায়। কুতুবুদ্দিন হাসি মুখে চোখ বোঁজে। মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছে সেই জয় জয় শিব শঙ্কর গানে মুমতাজের মতো হাতে বোতল নিয়ে টিলার গা বেয়ে নেমে আসছে "ছেমড়ি"...পাদদেশে নজরুল না কুতুবের গলাতেই সুর ...ওরে আয় গানের প্রিয়া সাথে তোর শরাব নিয়া....

নিজের সীটে গিয়ে ভোম হয়ে বসে থাকে শারমিন। ট্রেন আর ঝাঁকি দেওয়ার জায়গা পাইলো না? একেবারে কুতুবের সামনে। আছাড় খাওয়ার পরেই চোখে পড়েছিল সুটকেসের উপর। কুতুবুদ্দিন পাটোয়ারী। এই নাম কোন স্বদেশীর না হয়েই যায় না। তারমানে এই সেই প্রত্যাশিত কুতুব। নামও কুতুব। চেহারাও কুতুবের মতো। এই ছ্যামড়ার সামনে মুখ দিয়া "বাল" বাইর হইয়া গেছে। স্টেশনে এরে নিতে নিশ্চয়ই পোলাপান আসবে। কীভাবে সেগুলিরে এড়ানো যায়? সামনের বগী দিয়া নাইমা সোজা গিয়া ট্রাম ধরা যায়। সেইটাই করবো। গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। ব্যাগ কাঁধে ফেলে সামনের দিকের দুটো কম্পার্টমেন্ট পরে দরজার পাশে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ট্রেন ধীরে ধীরে ভিলহেল্মসহোয়ে স্টেশনে ঢুকতে থাকে।

কিন্তু একি ! কুতুবুদ্দিন হাসিমুখে সুটকেস টানতে টানতে এদিকে আসছে কেন?

(তৃতীয় দৃশ্য)

মকবুল আর জসীম বসে আছে প্লাটফর্মের মাঝামাঝি ধাতব বেঞ্চে। ট্রেন ঢুকছে। দ্বিতীয় বগীর দরজায় শারমিনের পালাবে কোথায় মুখ। মকবুল আর জসীমের মুখে হাসি ফোটে। এবার জমবে মজা।

ট্রেন থামতে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শারমিন শুকনো মুখে বলে,
- হাই..
- কি ব্যাপার তোমার না সোমবার সকালে আসার কথা?
- আরে মামামামী ইটালী যাবে...রওনা দিয়া দিছে এতোক্ষণে। মামার কলিগের বিয়া না কি জানি...
- যাক ভালোই হইছে। ঐ পোলাও আইতাছে এই ট্রেনে।
- তাই নাকি! অবাক হবার ভান করে শারমিন।

-এক্সকিউজ মি!
পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকায় জসীম।
- আপনি কি জসীম?
- হ্যা। আমি জসীম ও মকবুল আর ও শারমিন।
শারমিন শুকনো মুখে দ্বিতীয়বার হাই বলে।
- ট্রেনে আপনাকে দেখে একবার মনে হয়েছিল জিজ্ঞাসা করি দেশ কোথায় ..কিন্তু হয়ে ওঠেনি
- না ঠিকাছে। আপনিও কি স্টুডেন্ট।
- হ্যা।

মকবুল তাড়া দিলো চলো সাতাইশে ট্রাম। আর তিন মিনিট আছে। কুতুব ঢাল বেয়ে সুটকেস টানতে গিয়ে বার কয়েক পিছিয়ে গিয়ে আবার যাত্রা করার পরিস্থিতি তৈরী করতে মকবুল বলে, দ্যাও আমারে। তোমারে তুমি কইলাম।
- আরে তুমিই তো কইবেন। তুইও কৈতে পারেন। আমি তো অনেক ছোট।
মকবুলের গায়ে অসুরের মতো শক্তি। আর দুবছর যাবৎ VWতে কামলা দিয়ে সেটা আরো বেড়েছে। সবচাইতে জোরে পা চালায় শারমিন। এই কুতুবের কাছাকাছি থাকতে অসহ্য লাগছে।

ট্রাম ছাড়ার ঠিক আধা সেকেন্ড আগে কোনরকমে চারজনে ঢুকে পড়লো। এক নম্বর ট্রাম ভিলহেল্মসহোয়ে থেকে রওনা দিলো শহরের দিকে। পরের স্টপেজে কিছুলোক নেমে যেতে একটা ফোর সিটেড খালি হয়ে যেতে দ্রুত সেটার দখল নিতে সাহায্য করে শারমিন। এসব কাজে মেয়েদের আলাদা দক্ষতা আছে।

- আমার বাসায় চলো.. জসীম শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলে..
- ক্যান?
- ডাকছি সবাইরে। নতুন একজন আসলো। আর অনেকদিন গেট্টুগেদার হয় না।
- আমি আগে বাসায় যাবো। ফ্রেশ হতে হবে। তবে ঘুম আসলে শুইয়া পড়বো। আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নাই।
- আরে খাইয়াদাইয়া একবারে যাইয়ো। ঘুম ভালো হইবো।
- না আগে বাসায় যাই।
- ওকে। তবে আসার চেষ্টা কইরো। সবাই থাকলে ভালো লাগবে।
- গাবিরে বলছো আসতে?
- মাসুমরে বলছি। ওরা গেলো কৈ জানি খেলার পরে। নিয়া আসতে বলবো নে।

চার স্টপেজ পরে ভাইগেলস্ট্রাসেতে এসে ট্রাম থামতে শারমিন নেমে গেলো।
- সী য়ূ..

এবার মনোযোগ পড়ে কুতুবের দিকে। সীটে গা এলিয়ে প্রশ্ন করে জসীম
- তুমি কোন ইউনিভার্সিটির?
- ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
- তাই নাকি? কোন কলেজ?
- ঢাকা কলেজ।
- ফিজিক্স?
- না বাংলা...সলজ্জ মুখে জানায় কুতুব।
- বাংলা থিকা...কোথায় এইখানে কোন ডিপার্টমেন্টে?
- গেরমানিস্টিক (Germanistik)
নবাগতের মুখে চোস্ত জার্মান শুনে এক সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা খায় জসীম আর মকবুল।
- তুমি কি দেশ থিকা জার্মান শিখা আসছো?
- বেশী না। দেশে তো এখন (ZMP)'র বেশী করা যায় না।
- সেইটা আবার কী?
- ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের পরীক্ষা।
- কতদিন লাগে তাতে?
- দুই বছর..
- তুমি দুই বছর ধইরা ঢাকায় এই বিদঘুটে ভাষা শিখছো?
- হ্যা...আসলে বিদঘুটে বইলাই শিখা আরাম পাইছি।
- তুমি তো দেখি রীতিমতো কুতুব !!! বলে হেসে ফেল মকবুল..
- হ্যা আমার মাও তাই বলে..
- অ্যা!

(চলবে)

No comments: