Monday, July 27, 2009

আহ্ কবিতা.... সবুজ বাঘ....

সবুজ বাঘের সাথে পরিচয় ১৯৯৮ সালের কোন এক ইলশে গুড়ি বৃষ্টির দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট অফিসের সামনের কালভার্টে। মুখভঙ্গী দেহভঙ্গীর পুরাপাগল বৈশিষ্ট্য কিছুকাল আগেই দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল। অভ্যস্ত কায়দায় ভেবেছিলাম এও জাহাঙ্গীরনগরের আর দশটা পাগলের মতো পাগলের লেবাস ধরতে ভালো পায়। তারপর সেই ইলশেগুড়ি বৃষ্টির দিনে ২৩তম ব্যাচের অভী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। শুরুতেই জানালো এই হচ্ছে অসুন্দর গুপ্ত। কবিতা লেখে। আমি স্বভাব সুলভ ভদ্রতায় জানালাম তাঁর নামও শুনেছি কবিতাও পড়েছি। আর দশটা নিয়মিত ভদ্রতার মতোই সেখানে পঞ্চাশ শতাংশের বেশী মিথ্যা মিশ্রিত ছিল। আসল কথা হচ্ছে তাঁর নামটা চোখে পড়েছিল ডিপার্টমেন্টের দেওয়াল পত্রিকায়। আজ সত্যিকথা স্বীকার করতে অসুবিধা নাই, অনিয়মিত টাইপ হওয়ায় নামটাই চোখে পড়েছিল, কামটা নয়। অর্থাৎ তাঁর কবিতা মোটেই পড়া হয় নাই তখন। তারপর চলে গেল বহুকাল কুশলবিনিময় জাতীয় ধুনফুন ভদ্রতায়। সে থাকতো ভাসানী হলে। আমি মীর মশাররফ হোসেন হলে। আমার হলে অসুন্দর গুপ্তর যত সহপাঠী ছিল তারা কেউই তাঁকে পছন্দ করতো না কোন অজ্ঞাত কারণে। তার উপর ওকে প্রায়ই দেখা যেতো বাম জগতে আমার অপছন্দের কোন এক দলে। আমার চৈতন্যে তখন উঁচু তাপমাত্রায় বামজ্বর। ছাত্রও ছিলাম রাজনীতির তাই সবকিছুকে রাজনীতির ছাঁকুনিতে দেখবার বদঅভ্যাস ছিল। আবার কবিতাও ছিল। প্রাণপণে কবিতা পড়তাম আর বিশেষ করে বিষ্ণু দে'র ভক্ত হবার চেষ্টা করতাম। সেই সময় ভাসানী হলে অসুন্দর গুপ্ত গং এর নানারকম নৈরাজ্যের গল্প শুনতাম আর মনে হতো এই ভোগবাদী মানুষগুলি জীবনের দ্বান্দ্বিকতাকে এড়িয়ে ক্ষণিকের আনন্দ পেতে নিজের আর পারিপার্শ্বের প্রভূত ক্ষতি করে চলেছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি করা আরো অনেকের মতো আমিও জানতাম না জীবনের দ্বান্দ্বিকতা কী বস্তু। উহা খায় না মাথা কিংবা অন্যকোথাও দেয়। নির্বাচিত কিছু লালবইয়ের নির্বাচিত পাঠে কিছু শব্দ মুখস্ত করা আর চলমান ঘটনা প্রবাহের সাথে তার জোরপূর্বক সাজুজ্য খোঁজার সেই বিভ্রমের যূগে বহু চেষ্টা সত্ত্বেও প্রগতিশীল প্রতিবেশের বহু খাইসলত, যেগুলো হয়তো অতিক্রম করা যেতো, কিন্তু অতিক্রম করা হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারফিশিয়াল প্রতিবেশে হয়তো তেমনটা সেভাবে সম্ভবও নয়। কিংবা হয়তো সম্ভব ছিল আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি। হতে পারে সবই আমার ব্যক্তিগত খাইসলত। এইসব হতে পারার মধ্য দিয়ে চলে গেলো আরো বছর দেড়েক। একসময় ভাগ্যের শিকে ছিঁড়লো। সেদিন ছিল সম্ভবত ২৮ তম ব্যাচের প্রথম ক্লাস বা ভর্তি পরীক্ষার শেষ দিন। সমাজ বিজ্ঞানের সামনে বসে ঝালমুড়ি খেতে খেতে অসুন্দর গুপ্ত আর তাঁর সহপাঠী নোভেলের সাথে টানা প্রায় ঘন্টা চারেক ধুনফুন আড্ডা দিলাম। তাতে রাজনীতি পেরিয়ে আলাপ কবিতায় ঢুকে পড়লো। তাতে ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহের প্যারামিটার নিম্নগামী হবার কারণেই হোক বা সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের প্রতি আমাদের সময়কার সহজাত জাহাঙ্গীরনগরীয় আকর্ষনের জায়গা থেকেই হোক, অসুন্দর গুপ্তের অদ্ভুতুড়ে কথাগুলি খুব ভালো লেগে গেলো। কিছুক্ষণ পরে আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করলাম সব কবিতাই আসলে নানারকম ধুনফুন। এর মধ্যে আনন্দদায়ক ধুনফুনগুলিই আসল কবিতা। নিয়মনীতি অনুসরণ করে স্কেলমেপে হাসি কান্না একধরণের বৈজ্ঞানিক বিভ্রম। কথাগুলি নতুন তো নয়ই বরং তার কিছুদিন আগেই নৈরাজ্যবিরোধী ফতোয়াবাজদের মতো এইসবের একচ্ছত্র সমালোচনা করে এসেছি। কিন্তু সেদিন অসুন্দর গুপ্তের, আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং তুমুল আনন্দদায়ক বাক্যালাপ খুলির ভিতর আমার মগজে আনন্দদায়ক পেণ্ডামোনিয়াম সৃষ্টি করে দিল। এর মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে সঙ্কটপূর্ণ বিন্যাস সমাবেশ, রাজনীতিতে যাদের সমর্থন করতাম সেখানকার লুরমা পরিস্থিতি সব মিলিয়ে আনন্দিত হবার বা বোধ করার বস্তুগত ভিত্তিগুলি জ্যামিতিক হারে কৃশকায় হয়ে আসছিল। সেই সময়টাতে অসুন্দরগুপ্তের কবিতা প্রথমবারের মতো মন দিয়ে পড়লাম। কবিতাটির নাম ছিল হাসপাতাল ..........

পরাজিতরা মাথা হেট করে চলে যাবে
আর বিজয়ীরা আনন্দে লাফাবে
লাফাতে লাফাতে যখন মুষড়ে পড়বে
আমি তখন আনন্দের ক্ষণস্থায়ীত্ব দেখে মুচকি হাসি
চোখ কথা বলে। বহুকথা না বুঝে বুঝে প্রেমে পড়েছি বহুবার
আর তাতে আমার এ অগোছালো জীবন আরো বেশি ঝড়ো কাক হয়েছে
টিনের চালে বৃষ্টি..পতনের শব্দ অধোপতনেরো
গড়িয়ে গড়িয়ে কতদূর?
তবু আমি ঠিকই টের পাই বৃষ্টি আর রঙিন প্রজাপতির শত্রুতা
আর সেই ছোট্ট মেয়েটা- যার আদরের বাড়াবাড়িতে ঘর ছাড়তে চায় না বেড়ালটা
অথচ বাড়ির সব্বাই তাকে বের করে দেয় রাস্তায়।
সেই মেয়েটা যার হুহু কান্নায় অভিভূত মুগ্ধ হয়ে আমি তাকে পড়াই
রবারি মানে ডাকাতি।
আর এই ঘোর আধুনিক কালেউ
জানি, আমার পায়ের আঙ্গুলের ক্ষত
ঢের বেশি কষ্ট দেবে
তবু আমি হাসপাতালে যাব না।


সেই থেকে রাপু খাপাং। বিষয়বস্তু নতুন না হলেও উচ্চারণ এতোটাই স্বতন্ত্র যে চৈতন্যে আলাদা করে গেঁথে না যাবার কোন উপায় নেই। সেই সময় প্রায় সবকয়টি বামপন্থী ছাত্র সংগঠণে ধ্বস নেমেছে। ধ্বসের সুবাদে তৈরী হলো দলত্যাগীদের সম্পূর্ণ নতুন একটা বন্ধুচক্র। প্রতিদিন নতুন নতুন কবিতা আর নতুন নতুন ফর্মের নৈরাজ্য। শাপলু'র (ডাক নাম) যেই টোনের সঙ্গে আজকের ব্লগীয় কবিতা পাঠকেরা পরিচিত তাঁর জন্ম সেই লণ্ডভণ্ড আনন্দের দিনগুলিতে। আমাদের সাধারণ অজানা রাশি ছিল ড্যাবস। যে একাধারে ধ্রুবক এবং চলক........এবং অবধারিত ভাবেই তর্কাতীত সুস্বাদু। গণিতের বিজ্ঞান যার এক নং অপছন্দ তা ই ড্যাবস। সেইসূত্রেই শাপলু এবং আরো কয়েকজনের মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরী হয়েছিল ড্যাবসের গান। অসুন্দর গুপ্ত যূগের কবিতা থেকে এই সময়ের কবিতাগুলি মারাত্মক রকম আলাদা। কিন্তু কবির নির্মাণশৈলী আগের তুলনায় অনেকবেশী মৌলিক এবং স্বত:স্ফুর্ত। বানিয়ে বলার কোন দায় নাই। আবার বেরসিক পাঠককে ব্যাখ্যারও কোন দায় নাই। কেউ মানে জানতে চাইলে সেখানে আরো একটা কবিতার জন্ম হতো। যাতে আগেরটার চাইতে অনেকবেশী আনন্দদায়ক বিভ্রান্তি থাকতো। যেমন একবার কে যেন জিজ্ঞাসা করেছিল একটা নম্র পিস্তলের গুলিতে কয়কন জাতি বিলুপ্ত হলো... এর মানে কী? জবাবে শাপলুর সাথে আমি আর প্রিন্স কোরাসে গেয়েছিলাম, কয়কন পাখির ডিম আমার কয়কন পাখির ডিম.......। কারণ যুক্তিগ্রাহ্য পৃথিবী আমাদের সামনে ধারাবাহিকভাবে ভ্রান্তধারণাগুলির ক্রমবর্ধমান তালিকা ছাড়া আর তেমন কিছু রাখছে না। যা কিছু রাখছে তার পরিমাণ অল্প এবং সেগুলি যাচ্ছে হিজলতমালের ছেলেদের পেটে। এই অবস্থায় আমরা কী করতে পারি একটা আনন্দদায়ক ভাঙচুরের পৃথিবীর পরিকল্পনা ভাঁজা ছাড়া? যেই পৃথিবীতে যেই বাড়িত ভাত রান্দা হয় সেই বাড়িত বসে পড়া যায়; সব মেয়েরা সব ছেলেদের খেলা দেয়.........। এত সহজ কথা যে না বুঝে, নিজের বিভ্রমঅবস্থিতি নিয়ে সে চুড়ান্ত বিভ্রমের পর্যায়ের মাঝামাঝি আছে, যেখান থেকে ড্যাবসের বাড়ির দূরত্ব সমান শূণ্যভাগের এক (১/০)। অথচ বুঝতে চাইলেই কিন্তু খুব সহজে বুঝা যায় এই তড়িকার কথা। কোথাও কোন নতুন কথা নেই। খুব সহজে পেটের ভিতরের কথাগুলি সরাসরি বের করে বলে ফেলা। তারপরেও দেখা যেতো শাস্ত্রজ্ঞ হতে চাওয়ারা এইগুলির দিকে রক্তচক্ষু হানছে। কারণ শাপলুর ভাষায় বিজ্ঞান সম্ভবত: সহজ যে কোন কিছুকেই অপছন্দ করে।

তারপর সেই যূগেরও শেষ হলো। সময়টা অতি সুস্বাদু ছিল বলেই হয়তো দ্রুত ফুরিয়ে গেলো। জীবনের ফেরে সবাই এদিকওদিক ছিটকে পড়লেও শাপলুর সাথে বন্ধুত্বটা থেকে গেলো। বা টিকে গেলোও বলা যায়। ততদিনে নানান উত্থানপতনে সেও আর অসুন্দরগুপ্ত নেই। পিতৃদত্ত ডাকনামেই তখন সবাই তাকে চেনে। সেই সময়ের টানাপোড়েনে...বিশেষত প্রতিষ্ঠানের প্রবল আক্রমণের মুখে অভিমান করে লেখা ছেড়ে দিয়েছিল শাপলু, কবিতা আর কখনো লিখবে না লিখলে গদ্য লিখবে এরকম একটা দূরবর্তী প্রত্যয়ে। একবার শুনতে পেলাম বিজ্ঞানভিত্তিক বন্ধুমহল তাকে নানারকম নিয়মিত যুক্তিতে বুঝিয়েছে যে সাহিত্য চর্চা এতো সহজ না। মহৎ সাহিত্য রচনা করতে গেলে প্রচুর পড়াশুনা করতে হয়। আর সহজ অনুভবগুলি হিসাব করে প্রকাশ করতে হয়। কারণ বেশী সহজ কথাই যদি বলবি তাহলে আর সাহিত্য কেন...ইত্যাদি। ততদিনে আমি হল ছেড়ে দিয়েছি। শাপলুও টাঙ্গাইলে। চিঠি মারফত জানালাম যারা এইসব ভগিচগি দেয় তাদের কথা গাট্টি বাইন্ধা কাঁচা পায়খানার বিষ্ঠা সাগরে অথবা পাকা কমোডে ফালাইয়া ফ্লাশ কইরা দিয়া খালি লিখতে থাকো। সেইসব পত্রালাপ কখনো ভুলবো না। কারণ সেই সময়কার একটা চিঠির সূত্র ধরেই এর প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে আমি সামহোয়ারইনে জেনেসিস নামের একটা সিরিজ লিখতে শুরু করেছিলাম। জেনেসিসের জেনেসিস নিয়েও লিখবো একদিন। আজকের আলাপ শাপলুকে নিয়েই থাক। তারপর আমি একসময় সময়ের নানান বিভ্রান্তির মুখে পড়ে চলে এলাম হিট্লুর দেশে। এসে প্রথম কয়েক মাসে টের পেয়েছি প্রবাসে নি:সঙ্গতা কতটা ভয়াবহ। ঐ সময়টায় আমার প্রধাণ বিনোদোন ছিল ইউনিভার্সিটির পিসি পুলে বসে বন্ধুদের ইমেইল পড়া। আর সেখানে শাপলুর একেকটা মেইল ছিল একেকটা আনন্দদায়ক বোমার মতো। যা ফোটে ঠিকই কিন্তু তাতে গা পোড়ে না...রসময় ওম্ পাওয়া যায়। সেইসব পত্রালাপে অসংখ্য কবিতা এসেছে। কবির অনুমতি ছাড়া সেগুলি প্রকাশ না করাই ভালো। তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম কবির আঙ্গুলগুলি লেখার জন্য হাঁসফাঁস করছে।

এইভাবে গেলো আরো বছর দুই। প্রবাসে যেই প্রতিবেশে ছিলাম বা আছি তাতে কবিতা দূরে থাক সাধারণ স্টেটমেন্টগুলিতেও কোথাও কোন ঐক্যের জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। বাস্তবের কঠোরতা তেমন আহত করেনি যতটা করেছে নিজের কথাগুলি কোথাও বাটোয়ারা করতে না পারার খেদ। শাপলুর মেইলও পেতাম মাঝে মাঝে। সেও লড়াই করে চলেছে পেটের দায় মেটাতে। এবং বিজ্ঞানও যথারীতি বিমাতাসুলভ আচরণে কোন ব্যতিক্রম আনছে না। এই সময়ে মেইল আগের মতো ঘন ঘন না পেলেও অন্তত মাসে একটা পেতাম। সময় দিন দিন আরো খারাপ হতে লাগলো।

এরকম একটা পরিস্থিতিতে একদিন হিমুর প্ররোচনায় সামুব্লগে ঢুকলাম। সেইকথা আগে বলছি অন্যখানে। সামুব্লগে একটু জমতে শুরু করার সময় শাপলুরে শুরু করলাম নতুন করে গুতানো। ছেলে কিছুতেই লিখবে না। তাকে নানান বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে রাজী করাতে করাতে চলে গেল আরো বেশ কয়েক মাস। প্রথমে গোটাদুই ছোটগল্প পোস্ট করলো। সম্পূর্ণ অপরিচিত কায়দায় লেখা বলে খুব বেশী পাঠক শুরুতে টানতে পারলো না। যদিও শমিত, তীরন্দাজ, হিমু, হযবরল'র মতো পাঠকেরা শুরুতেই রতন চিনতে ভুল করেনি। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে একদিন রাতে কামলা থেকে ফিরে দেখলাম ফ্রন্ট পেইজে শাপলুর কবিতা। প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে প্রথমবারের মতো আবার হারানো ড্যাবসের স্বাদ পেলাম। কবিতার নাম ছিল কে যেন আমারে কামুড় দিল......

এক ঝুম বৃষ্টির বিকালে কে জানি আমারে কামুড় দিল
সম্ভবত কুত্তায়।
নইলে কেন আমি কুত্তাপাগল হয়ে একদল হাড় হাভাতেকে বলবো
এই বেঞ্চোদের বাচ্চুরা দাঁড়াও
তোমাদের আইজ আমি বড় ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত বানামু
তার আগে তোমরা তোমাদের লিঙ্গটাকে সাফ সুতরো করে নাও
এবং বিকালের বৃষ্টিতেএকটু ফিফি করে কাঁদো
জানি, কেউ কারো কান্না না বোঝো না শোনো
তারপর ভাংচুরের আবহ আনো নিজেদের ভিতরে
এবং তুমুল গর্জনে হাসিতে ফেটে পড়ো বিজলির মতোন
পৃথিবীতে হাসি ছাড়া আর ভালো কিছু দেখি নাই।


এর কয়েকদিন পরে সব শ্যালকপুত্রই গেছে মরে

প্রজাপতি সিন থেকে বিবর্ণ জ্বিন
সব শালাই গেছে মরে
ভাংচুরেও আজ আনন্দ নাই , খালি প্যাটের ভিতর বেদনা কুহু কুহু ডাকে
পালতোলা ঘুড়া কিংবা বালতোলা ভেড়া
সব ছেড়ে দেই শুধু হাম্বা ব্যতিরেকে
নিহত ডাইনোশুয়োর কিংবা টোনাটুনির বীর্যপতন
মিশিমার বিড়ালখানিকে অযথাই ডাকে,
আয় আয় আয়, খেলাখেলি খাই।
মিশিমার বেড়াল, উড়াল দেওয়ার যাতনায়
থিরথির করে কাঁপে, পাছার কাপড় তোলে হিশহিশিয়ে হিশি করে আর থিরথির করে কাঁপে, কাঁদে উড়ে যাবার যাতনায়
হে বিনীত মানুষ, পীতরাজ বৃক্ষের গোটা
যৌবনে জান বাজি রেখে লড়ে যাও,
গন্তব্য অজানা।।
তাই বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে
সিলিং ফ্যানের ইঞ্চি সাতেক নীচে
মাথা গিয়ে পৌঁছায়,
ও বাবাগো বলে বিছানায় পড়ে গিয়ে মাথা বাঁচাই।
পৃথিবীতে আজ ভাংচুরেও আনন্দ নাই, তাই
শুধু চুদাচুদির মহোত্তম পাপে নিজেকে জড়াই।
জড়িয়ে মুড়িয়ে ঘন সব পাপ খেয়ে নিজেতে শুধাই
সব শ্যালকপুত্রই কি আমার মতো গেছে মরে?

সাড়া পড়ে গেলো। যারা বুঝলো তাঁরা ছাড়াও যারা বুঝলো না তাঁদের মধ্যেও। সারাদেশে আর সারাব্লগ জগতে তখন ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘাতের যূগ। এই সব কিছুর মধ্যে ছোট ছোট কিছু বিরতি দিয়ে শাপলুর কবিতা আসতে থাকলো। টোনে আর রূপকল্পে যে পরিবর্তনগুলি ২০০১-২ সালের সেইসব লণ্ডভণ্ড সময়ে লক্ষ্য করেছিলাম তার ততদিনে পরিপক্কতা এসে গেছে। নিয়মিত জীবনের হাহাকার আর প্রাণী হয়েও মানুষ হতে বাধ্য হওয়ার মর্মভেদী বেদনার অতিপুরাতন কথাগুলি যেকোন পাঠকের খুব কাছে এসে আছড়ে পড়া সেই দুর্ধর্ষ কবিতার স্রোত, কর্পোরেট ছাপামাধ্যমকে কাঁচকলা দেখিয়ে তার জায়গা করে নিলো। বাংলা ব্লগাবর্তের জন্ম যে কয়জন হারিয়ে যাওয়া কবিকে পূর্ণজন্ম দিয়েছে, শাপলু তাঁদের তালিকার একেবারে শুরুতে। পেটের কথাকে এমন সুস্বাদু করে সরাসরি পাঠকের সামনে নিয়ে আসার জন্য ব্লগের মতো কোন মাধ্যম আবশ্যক ছিল। হাংরি প্রজন্মের কবিতাতেও এতটা সরাসরি প্রকাশ বিরল ছিল... আমার অতিক্ষুদ্র কবিতাজ্ঞান তাই বলে। আর কেউ যদি বলেও থাকে সেগুলো তাঁদের কবিতা। শাপলুর টোন এখানে পুরোপুরি মৌলিক। যেমন বিড়াল আর বনবিড়ালির ধাওয়া খেয়ে কবিতাটির কথাই ধরা যাক.....

নিরীহ বাঘ কিংবা বুড়ো বিড়ালের কাছে আমি পিছু হটি
হাঁটি পুরনো খানাখন্দে ভর্তিপ্রেমিকাদের বাড়ির রাস্তায়
যদিও রিস্কি এইসব শট খেলা, তারপরও খোলাখুলি বলি
আমার চরিত্রের ওইসব দোষ আজও গেল না
হে পিতামহ, নিহত পিতৃব্য ডাইনোশুয়োরদের মেলায়
ঘাস আর বিচালিতে ঠাঁসা, ডাঁশা পেয়ারার বুক নিয়ে হেঁটে যায় মেয়েরা, আমিও হাঁটি বুক তদারকিতে পিছু পিছু
ভালো লাগে না, তবুভালো লাগাই হাঁটি আর হেঁটে যাওয়া দেখায়
পৃথুলা রমণীর নিতম্বের রমণ পেট ভরে খাওয়ার ইচ্ছা প্রতি মুহূর্তে হেঁটে হেঁটে মারি
হে ডাইনোশুয়োর পাপিষ্ঠ ধমনী
বিউগলের চুমুতে সুর বাজে অবিরত, মিঠাই আর মণ্ডা খাওয়ার ঝাল মেটাই নিয়ত অন্ধকারে
ভাগীরথীর তীরে ভগ্নমনোরথে
তাল তমালের বনঘেরা জঙ্গলে
চিরিক চিরিক করে মুতি
মুতি আর পিছু হটি
বিড়াল আর বনবিড়ালির ধাওয়া খেয়ে


বিড়াল আর বনবিড়ালির ধাওয়া সবাই খায়। কবিরা তা স্বীকারও করেন। তবে প্রায়ই নিয়মিত কবিতার ভনিতা এইসব আকুতির সত্যকে কাব্যময় শব্দের মোড়কে বাঁধতে গিয়ে পাঠক থেকে কিছুটা দূরে নোঙর ফেলে। কবিতার গায়ে প্রচলিত কাব্যময়তার জ্যাকেট পড়াতে আর কবিতার প্রচলিত বৈঠকী আড্ডায় শেখা বা বই পড়া বিদ্যায় কবিতার গায়ে দশকের ট্রেন্ডের খোলস চাপাতে গিয়ে কবির নিজস্ব নির্মাণের জায়গাগুলি ধূসর হতে থাকে। অন্তত নির্বোধ পাঠক হিসেবে আমার সেরকমই মনে হয়েছে। শাপলুর কবিতাগুলি এই সময় থেকে নিজস্ব শব্দ আর রূপকল্পের নির্মাণ তাঁর নিজস্ব পাঠকবর্গ গড়ে তোলে। শুধু প্রাণী হিসাবে শরিরের কথা না, একটা পরিপক্ক নিজস্ব সমাজদৃষ্টি ফুটে ওঠে এই সব কবিতায়। যেমন ২০০৭ সালের জানুয়ারীতে যখন ব্লগাবর্তে সকলেই সমঝে কথা বলছেন, শাপলু তখন অবলীলাক্রমে কবিতায় অনেক কিছু বলে ফেলে। এরকম একটি কবিতার নাম ছিল বাঘ

একদিন নিকারাগুয়ার পথে একটা বাঘ দেখেছিলাম
শান্তিপূর্ণ স্বচ্ছল। আমি বাঘের কাছে গিয়ে
বললাম, ভাই বাঘ..নুনুটা দেখাও তো?
তিনি আমাকে নুনুটা দেখাতে পারলেন না।
অতএব মনে রাখবে নুনু ছাড়া কোনো বাঘ হয় না।
যদি ভাঙচুরের রাজত্বে তুমার মতি থাকে
তবে ততি সেজে বসে থাকলে মানুষ তুমার নিকারাগুয়া দূরে থাক, মানাগুয়াও মারবে না।


যতদূর মনে পড়ে এটাই ছিল ব্লগে ১/১১'র প্রথম প্রতিক্রিয়া। এর কিছুদিন পরে আবার রাজনীতি উঠে এলো বিল্লাল দারোগা নামের কবিতায়...

একটা তৃতীয় মাত্রার মিষ্টি বাঘ এবং একটা প্রচলিতঘুড়ার মধ্যে
বন্ধুতা স্থাপনের সুযোগটা গত মঙ্গলবার মাঠে মারা গেল।
অথচ এ কথা আকছারই শোনা যায়, বিল্লাল দারোগার ভয়ে
বাঘ আর প্রচলিত ঘুড়া একই খালে জল খায়।
ঘাস খায় একই মাঠে।
অথচ বিল্লাল দারোগা বেশিদিন বাঁচলো না
ওরে ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্টে হিউজ বানাইছিল আমরিরা।
কারণ বিল্লাল শালায় আমরিরেও ঘাস খাওয়াইবার চাইছিল একই খালে। তাই মঙ্গলবার আসলেই এহন আর কোনো মিষ্টি বাঘ কিংবা প্রচলিত ঘুড়ার মধ্যে বন্ধুতা সম্ভব নয়।
কারণ বিল্লাল দারোগারে হিউজ বানাইছিল আমরিরা,
আইজ থিক্যা প্রায় দেড় দশক আগে।
তারপরই রাগে দুঃখে ক্ষোভে বিল্লাল মারা যায়
বাঘ আর ঘুড়ারে এক খালে জল খাওয়াইতে না পাইড়্যা


সামুব্লগে সে তার পিতৃদত্ত নামেই লিখতো। পাঠকরা সেখানে তাকে আবু মুস্তাফিজ নামে চিনতো। তারপর নানান ঝড়ের মধ্য দিয়ে জন্ম হলো সচলায়তনের। সামুব্লগে আর লেখালেখির পরিস্থিতি ছিল না। অন্তত তখনকার উদ্ভুত পরিস্খিতিতে শাপলুর মতো কবির পক্ষে ঐ পরিবেশে টিকে থাকা কঠিণ ছিল। আর যে পাঠকবর্গ সে পেয়েছিল তার প্রায় সবাই তখন সচলমুখী। সামুতে শেষ কবিতার নাম ছিল বাঘ মানাগুয়া দৌড়াচ্ছে

বস্তুত ফালতু বকে লাভ নাই।
কারণ ভর্দলোকেরা ফালতু বকা ভালবাসে না।
অথচ কী মুশকিল, ভর্দলোক ছাড়া ফালতু বকে মজাউ নাই খুব এট্টা
এই যখন দশা, তখন নিকারাগুয়া এক পিলে চমকানো
সম্বাদ দিল, উহাদের দেশে নাকি সুন্দরী মেয়েরা
ফালতু খেলতে ভালবাসে। ডাল তরকারি খেয়ে দিনরাত বসে থাকে ফালতু খেলবে বলে।
এই সম্বাদ পেয়ে চলে গেলাম নিকারাগুয়ার ঘন জঙ্গলে।
জঙ্গলে বানরেরা ধরল পরথম। কীরে ফালতু খেলতে এয়েছিস?
বললাম, জ্বি হা। ফালতু খেলতেই এয়েছি। বানরেরা পোদ ফাটিয়ে হাসল, সেই শব্দে বাঘ আসল। এসেই বানরদের উদ্দেশ করে বলল, কীরে মাল পেয়েছিস ফালতু খেলার?
বানরেরা উত্তর করল, জ্বি হা জনাব, মাল পেয়েছি বৈকি। সামনেই দণ্ডায়মান। এরপর কিছু বুঝার আগেই বাঘ আমাকে ডাল তরকারি ছাড়াই ফালতু মেরে দিল। এবং তার পেটের ভিতর ঘুমিয়ে পড়তে পড়তেই টের পেলাম, বাঘ মানাগুয়া দৌড়াচ্ছে ফালতু খেলবে বলে।


......এরকম অভিনব কায়দায় বিদায়বার্তা জানিয়ে সামু থেকে চলে এলো সচলায়তনে। নাম নিল সবুজ বাঘ। সামহোয়ারইনে লেখা কবিতাগুলি সে আর সচলে আনে নি। বলে কয়ে সেগুলিকে স্থানান্তর করানো হলো ব্লগস্পটের এই ঠিকানায়। তারপর থেকে সবুজ বাঘ লিখে চলেছে সচলায়তনে। একের পর এক ভয়াবহ মৌলিক কবিতা জন্ম নিচ্ছে। যার অর্থ সহজ সরল কিন্তু প্রকাশ মৌলিক। নিজস্ব ভাষার গুণেই পাঠককে মনোযোগ দিতে সে বাধ্য করেছে। সচলায়তনে অবশ্য আরো একটা জিনিস যোগ হয়েছে। সবুজ বাঘের গদ্য। যে কয়টা ছোট গল্প এই পর্যন্ত সচলে প্রকাশিত হয়েছে তার বিচার সচলরা করবেন। সবুজ বাঘের গদ্য নিয়ে আমি আর কিছু বলবো না। আধুনিকতার টানাপোড়েন আর ভণ্ডামীগুলি উত্তরাধুনিকতাতেও অনুপস্থিত নয় বরং দুটোই কোন না কোনভাবে বস্তুজগতে জৈবযৌগ হিসাবে মানুষের স্বত্তাকে কৃত্রিম মোড়কে সত্যিকারের প্রাণীর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে চলেছে, কবির এই দর্শন তাঁর গদ্যতেও অক্ষুন্ন আছে এইটুকু বলতে পারি।

অনেক ধুনফুন কথা বললাম। সেইসাথে খানিক ব্যক্তিগত স্মৃতি খাউজানিও হলো। নেপোটিজমের অভিযোগও হতে পারে। হোক। ব্লগ লেখার সুবিধা এখানেই। লিখতে মন চেয়েছে লিখেছি। অসুবিধা কী?

No comments: