৭ নভেম্বর। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে একটা করে ৭ তারিখ থাকে। অনেক ৭ নভেম্বর অনেক কিছু ঘটে থাকে। বাংলাদেশে ৩৩ বছর আগে এক সাতই নভেম্বর সিপাহিরা পথে নেমে ছিল। অফিসারদের রক্ত চেয়ে তার তড়িৎ পরিণতি ঘটেছিল প্রতিবিপ্লবে।
একানব্বই বছর আগে রুশদেশে আরো এক সাতই নভেম্বর এসেছিল। পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র, প্রথম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাতই নভেম্বর। জানা ইতিহাস মোতাবেক সেই নভেম্বরের বিপ্লবই পুঁজিবাদী সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে বৃহত্তম প্রতিরোধ। মার্কস-এঙ্গেলস ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতার নিয়ম প্রয়োগ করে পুঁজির সঞ্চয়ন আর বিকাশকে বুঝতে চেয়ে আবিস্কার করেছিলেন উদ্বৃত্ত শ্রম শোষনের বিপরীতে বিকাশমান ক্রমবর্ধমান সর্বহারা শ্রেণীকে। ঊনিশ শতক জুড়ে সর্বহারা শ্রেণী বিকশিত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান পুঁজির সাথে তাদের লড়াইও বিকশিত হয়েছে ১৮৪৮ থেকে প্যারিস কমিউনে, প্যারিস কমিউন থেকে ইউরোপের দেশে দেশে। ১৮৪৮এ কমিউনিস্ট লীগের ঘোষনাপত্র "কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার" লেখেন মার্কস-এঙ্গেলস যৌথভাবে। ১৮৬৪ তে প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক গঠিত হয়। কর্মপদ্ধতি আর বিশ্বদৃষ্টির বিতর্ক থেকে জন্ম নেয় ১৮৮৯ তে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক। সকলেই সর্বহারা শ্রেণীর বিশ্বজনীনতায় মোটামুটি একমত ছিলেন। কিন্তু সময়ের আশু কর্তব্য নির্ধারণে টানাপোড়েন চলতে থাকে। এই মুহুর্তে কী করণীয় সেই প্রশ্নের পরিস্কার জবাব দেবার চেষ্টা করেন ভ্লাদিমির উলিয়ানভ লেনিন ১৯০১ সালে "কী করিতে হইবে : সময়ের জলন্ত জিজ্ঞাসা" নামের একটা চটি বইতে। রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা লেনিনের সাথে একমত হন। রুশভাষায় বলশেভিক অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ।
১৯১৭'র ফেব্রুয়ারীতে জারের পতন ঘটে। মেনশেভিকরা ক্ষমতায় বসে। পুরনো ক্যালেন্ডার মতে ২৫ অক্টোবর, নতুন ক্যালেন্ডার মতে ৭ নভেম্বর বলশেভিকদের নেতৃত্বে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতা দখল করে। মার্কিন সাংবাদিক জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন নামের বইয়ে পাওয়া যাবে বিপ্লবের মহাকাব্যিক বর্ননা।
সর্বহারা বিপ্লবের তত্ত্ব, তত্ত্ব থেকে বাস্তব অনুশীলনের রূপ পায়। শুধু ব্যাখ্যায় নয় কার্যত: পৃথিবীকে বদলে দেবার যে কথা মার্কস বলেছিলেন থিসিস অন ফয়েরবাখ এর একাদশ থিসিসে, ১৯১৭'র ৭ নভেম্বর ছিল প্যারিস কমিউনের পরে তাঁর প্রথম সংগঠিত বাস্তব প্রয়াস। ৭ নভেম্বরের রুশ বিপ্লব প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামিয়ে দেয়। ১৯১৯ সালে বৈশ্বিক সর্বহারা বিপ্লবের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক। দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হতে থাকে.........
এই ইতিহাস এবং পরবর্তী ইতিহাস সবাই জানেন। তৃতীয় আন্তর্জাতিক আর সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটোই এখন ইতিহাস। লেনিনের সেদিনকার জবাবও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতার পরবর্তী রসায়নে ক্রমশ: প্রাসঙ্গীকতা হারিয়েছে হারাচ্ছে। কিন্তু সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্ন নিভছে না। পুঁজির কেন্দ্রীভবন আর সেইসূত্রে বাজার সম্প্রসারণ বিচিত্র চেহারায় তাঁর অ্যান্টি থিসিসের বিকাশকেও থামিয়ে দিতে পারছে না। ঈশ্বরের মতোই মনোপলি সহায়ক আধ্যাত্তিকতা প্রান্তিক মানুষের রক্তকে বরাবরের মতো তাঁদের মেন্যুতে মেইন কোর্স হিসেবে রেখেছে রাখছে।
সুতরাং শোষণমুক্তির সংগ্রাম থেমে যাবার কোন সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। সংগ্রামের পথে ইতিহাস একই সাথে প্রেরণা আর বস্তুগত অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের উপাত্ত। ইতিহাস বিরোধীতার তত্ত্বে আনন্দনাড়ু কাটুক মহাজনের মোটা বেতনের নায়েবগোমস্তারা। কৃশ থেকে কৃশতর কামলারা পেটের দায়েই ইতিহাস ঘেঁটে দেখছে দেখবে।
প্রত্যেক সময়ের নিজস্ব কী করিতে হইবে বর্তমান। এই সময়ে যারা এই সময়ে এই জ্বলন্ত প্রশ্নের জবাব যারা খুঁজছেন ১৯১৭'র ৭ নভেম্বর তাঁদের কাছে জীবিত।
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!
No comments:
Post a Comment