আরিফ জেবতিকের সঙ্কলনে ছেলেবেলার গপপো দিতে না পারার কৈফিয়ত দিয়ে নিচ্ছি আগেই। বিগত ১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ রোজ শনিবার সন্ধ্যায় হিমুকে রিসিভ করতে ফ্রাঙ্কফুর্ট যাত্রার পূর্ব মুহুর্তে আমার অতি সাধের পঁচা কম্পিউটারটা দীর্ঘদিন কমাতে টিকটিক করে শেষ পর্যন্ত ফুলস্টপ হয়ে গেল। প্রথম কয়েকদিন বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা মেনে নিলাম। কিন্তু কম্পু এমনই জিনিস যার কোন ভার্চুয়াল প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। এই লেখাটা শুরু করেছিলাম ইউনিভার্সিটির পিসিপুলে বসে। তারপর কম্পু ঠিক হলেও আর লেখাজোখা তেমন হয়ে ওঠেনি। সময়ের কাজ সময়ে না সারলে যা হয় আরকি। পড়ে থাকলো খসড়া। একমাস,দুমাস,তিনমাস.....
ছেলেবেলার কাহিনি। ছেলেবেলা পুরোটাই রীতিমতো একটা মেগা সিরিয়াল। প্রতিদিনই সাসপেন্স। চোখে দেখা যায় না। খুঁজে নিতে হয়। সময় ভ্যাবলা হতে ধরলে নিজ দায়িত্বে সাসপেন্স সৃষ্টি করা যেতে পারে। সাসপেন্স পেতে শুধু যে এ বাড়ি ও বাড়ির ফলগাছে হামলা করতে হবে তা নয়, প্রচুর মারধোর-ধমকধামকের পরেও হোমওয়ার্ক করাতে না পারা গৃহশিক্ষকের অসহায় দৃষ্টি চেখেও সাসপেন্স পাওয়া যেতে পারে। আমি পেতাম। বরিশালাগত দেলোয়ার স্যার কাঁদো কাঁদো স্বরে "ল্যাখেনা কা..." বলে আর্তনাদ করে উঠলে শরির থেকে যাবতীয় মারধোরের কষ্টদূর হয়ে যেত। আরো ভালো লাগতো বৃহত্তর নোয়াখালীর(ফেণী) সেলিম স্যার যখন পেয়ারা গাছের ডাল নিয়ে তাড়া করতেন। সেলিম স্যারের অবশ্য আরো ইন্টারেস্টিং কাজ ছিল পেয়ারা গাছের সরু ডাল দিয়ে বানানো বেত দিয়ে মশা মারা। আমাকে চলিত নিয়ম কিংবা বিঘা-কাঠা ও ছটাকে ক্ষেত্রফল নির্নয়ের মতো বদ্খত কিছু করতে দিয়ে বাকি সময় ব্যস্ত থাকতেন মাছি মারায়। মাছি মারার গর্বে চকচক করতো তার চোখ। পরে আমি অনেক চেষ্টা করেও দু-চারটার বেশী মাছি মারতে পারি নাই। এরকম সাসপেন্স ছড়িয়ে আছে পুরো স্কুল জীবন ধরে। গলির মাথায় থাকতেন মোকলেস সাহেব। তিনি তেমন সমস্যা নন। সমস্যা তার স্ত্রী। প্রায়ই দেখতাম তার বাসার বাইরে উৎসাহী তামশগীরদের ভিড়। মোকলেস সাহেব আর তার পুত্র যৌথভাবে ধোলাই হচ্ছেন ভদ্রমহিলার হাতে। হাতে নয়। ভদ্রমহিলা রীতিমতো খাটের স্ট্যান্ড দিয়ে স্বামী-পুত্র ধোলাই করতেন। তাঁদের চিৎকার প্রতিবেশীদের আনন্দিত করতো। আশির দশকের প্রথমার্ধে ভদ্রমহিলা ছিলেন গলির ত্রাস। শাড়ীর সাথে বেইলী কেডস পড়ে প্রাত:ভ্রমণে বেরুতেন। তাঁর দু:সম্পর্কের মামা এরশাদের মন্ত্রী হওয়ায় ভদ্রমহিলার তাপমাত্রা তিনগুণ হয়েছিল। ১৯৯০ নাগাদ সেটা পৌছুল দশগুণে। কার্ফুর সময় আমাদের বাসায় এসে বলে গেলেন কোনো সমস্যা নাই তিনি কালই মমতা ওহাবের কাছ থেকে কার্ফু পাস এনে দেবেন। তার কার্ফু পাস আর আনা হলো না। লেজেহোমো এরশাদ ভাগলেন পাবলিকের জুতো খেয়ে। তখন আমি ক্লাস নাইনে।
সেই ১৯৯০। সেপ্টেম্বর থেকে ফুঁসে উঠেছিল আন্দোলন। তখন দুইদিন স্কুল খোলা, তো তিনদিন হরতাল। ফাইনাল পরীক্ষার টেনশনের সাথে রাজনীতির টেনশন মিলিয়ে গলির লরা-মেরীদের কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। নভেম্বরের শুরুতে ক্লাস সাসপেন্ড হবার কিছুদিন আগে বন্ধু ইরান হাঁফাতে হাঁফাতে ক্লাসে এসে জানালো খবর আছে। বললাম কি? বলে, লাকি পলাইছে। বললাম অ্যা! কার লগে? কয়, হেকমত। হেকমত ছিলেন প্রাইভেট টিউটর। লাকিরা তিনবোন তার ছাত্রী। আমি ভেবেছিলাম তার নজর বড় বোনের দিকে। ইরান বললো ঘটনা সত্য। তবে শেষ মুহুর্তে হেকমত সিদ্ধান্ত বদল করে। এরপর কয়েকদিন গলিতে ব্যপক সাসপেন্স। সবাই চিন্তিত এরশাদের আর বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে, আমাদের বন্ধুমহলে আলোচ্য তালিকায় গলির মাল্টিভগ্নিপ্রতিবেশীদের গুরুত্ব তার থেকেও খানিক বেশী। ড.মিলন নিহত হবার তিনদিন পরে শোনা গেল হেকমত দম্পতির আবির্ভাবে বড়বোন কীটনাশক খাবার উদ্যোগ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তারপর মড়া কান্না। গুরুজনেরা দুইবোনেরই বহি:স্কারাদেশ দিলেন। কার্যকর হলোনা কার্ফুর কারণে। ৪ ডিসেম্বর রাতে চারিদিকে উৎসব। লাকি কাহিনি তখন গৌণ। ১০-১১ তারিখে শুনলাম বড়বোন, তার খালাকে দিয়ে কেস ঠুকেছে ছোট বোন আর প্রাক্তন টিউটরকে ফাঁসিয়ে। সবাই গ্রেফতার। অবশেষে নির্বাচনের কিছু আগে দুই পরিবারে রফা হলো। তবে নাবালিকা বলে লাকি আর বৌ হতে পারলো না। শালীত্বে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। থাবা শান দিতে দিতে অপেক্ষা করতে থাকলো সাবালিকাত্বের। এর সাড়ে তিন বছর পরে, তখন তেজগাঁ কলেজে পড়ি, শুনলাম লাকি নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছে, বোনের ননাসের জামাই অর্থাৎহেকমতের দুলাভাইকে ভাগিয়ে। এবার আর কাঁচা কাজ নয়। বছর ঘুরে কোলে ট্যাঁ ফোঁ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।
এটা অবশ্য ঠিক ছোটবেলার গল্প নয়। কৈশর পার হতে থাকা সময়ের গল্প। আঙ্গুলের ডগায় এলো বলে লিখে ফেললাম। ছেলেবেলা আরো পেছনে। তার গল্প লিখে ফেলবো কখনো। কবে জানিনা।
ছেলেবেলার কাহিনি। ছেলেবেলা পুরোটাই রীতিমতো একটা মেগা সিরিয়াল। প্রতিদিনই সাসপেন্স। চোখে দেখা যায় না। খুঁজে নিতে হয়। সময় ভ্যাবলা হতে ধরলে নিজ দায়িত্বে সাসপেন্স সৃষ্টি করা যেতে পারে। সাসপেন্স পেতে শুধু যে এ বাড়ি ও বাড়ির ফলগাছে হামলা করতে হবে তা নয়, প্রচুর মারধোর-ধমকধামকের পরেও হোমওয়ার্ক করাতে না পারা গৃহশিক্ষকের অসহায় দৃষ্টি চেখেও সাসপেন্স পাওয়া যেতে পারে। আমি পেতাম। বরিশালাগত দেলোয়ার স্যার কাঁদো কাঁদো স্বরে "ল্যাখেনা কা..." বলে আর্তনাদ করে উঠলে শরির থেকে যাবতীয় মারধোরের কষ্টদূর হয়ে যেত। আরো ভালো লাগতো বৃহত্তর নোয়াখালীর(ফেণী) সেলিম স্যার যখন পেয়ারা গাছের ডাল নিয়ে তাড়া করতেন। সেলিম স্যারের অবশ্য আরো ইন্টারেস্টিং কাজ ছিল পেয়ারা গাছের সরু ডাল দিয়ে বানানো বেত দিয়ে মশা মারা। আমাকে চলিত নিয়ম কিংবা বিঘা-কাঠা ও ছটাকে ক্ষেত্রফল নির্নয়ের মতো বদ্খত কিছু করতে দিয়ে বাকি সময় ব্যস্ত থাকতেন মাছি মারায়। মাছি মারার গর্বে চকচক করতো তার চোখ। পরে আমি অনেক চেষ্টা করেও দু-চারটার বেশী মাছি মারতে পারি নাই। এরকম সাসপেন্স ছড়িয়ে আছে পুরো স্কুল জীবন ধরে। গলির মাথায় থাকতেন মোকলেস সাহেব। তিনি তেমন সমস্যা নন। সমস্যা তার স্ত্রী। প্রায়ই দেখতাম তার বাসার বাইরে উৎসাহী তামশগীরদের ভিড়। মোকলেস সাহেব আর তার পুত্র যৌথভাবে ধোলাই হচ্ছেন ভদ্রমহিলার হাতে। হাতে নয়। ভদ্রমহিলা রীতিমতো খাটের স্ট্যান্ড দিয়ে স্বামী-পুত্র ধোলাই করতেন। তাঁদের চিৎকার প্রতিবেশীদের আনন্দিত করতো। আশির দশকের প্রথমার্ধে ভদ্রমহিলা ছিলেন গলির ত্রাস। শাড়ীর সাথে বেইলী কেডস পড়ে প্রাত:ভ্রমণে বেরুতেন। তাঁর দু:সম্পর্কের মামা এরশাদের মন্ত্রী হওয়ায় ভদ্রমহিলার তাপমাত্রা তিনগুণ হয়েছিল। ১৯৯০ নাগাদ সেটা পৌছুল দশগুণে। কার্ফুর সময় আমাদের বাসায় এসে বলে গেলেন কোনো সমস্যা নাই তিনি কালই মমতা ওহাবের কাছ থেকে কার্ফু পাস এনে দেবেন। তার কার্ফু পাস আর আনা হলো না। লেজেহোমো এরশাদ ভাগলেন পাবলিকের জুতো খেয়ে। তখন আমি ক্লাস নাইনে।
সেই ১৯৯০। সেপ্টেম্বর থেকে ফুঁসে উঠেছিল আন্দোলন। তখন দুইদিন স্কুল খোলা, তো তিনদিন হরতাল। ফাইনাল পরীক্ষার টেনশনের সাথে রাজনীতির টেনশন মিলিয়ে গলির লরা-মেরীদের কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। নভেম্বরের শুরুতে ক্লাস সাসপেন্ড হবার কিছুদিন আগে বন্ধু ইরান হাঁফাতে হাঁফাতে ক্লাসে এসে জানালো খবর আছে। বললাম কি? বলে, লাকি পলাইছে। বললাম অ্যা! কার লগে? কয়, হেকমত। হেকমত ছিলেন প্রাইভেট টিউটর। লাকিরা তিনবোন তার ছাত্রী। আমি ভেবেছিলাম তার নজর বড় বোনের দিকে। ইরান বললো ঘটনা সত্য। তবে শেষ মুহুর্তে হেকমত সিদ্ধান্ত বদল করে। এরপর কয়েকদিন গলিতে ব্যপক সাসপেন্স। সবাই চিন্তিত এরশাদের আর বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে, আমাদের বন্ধুমহলে আলোচ্য তালিকায় গলির মাল্টিভগ্নিপ্রতিবেশীদের গুরুত্ব তার থেকেও খানিক বেশী। ড.মিলন নিহত হবার তিনদিন পরে শোনা গেল হেকমত দম্পতির আবির্ভাবে বড়বোন কীটনাশক খাবার উদ্যোগ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তারপর মড়া কান্না। গুরুজনেরা দুইবোনেরই বহি:স্কারাদেশ দিলেন। কার্যকর হলোনা কার্ফুর কারণে। ৪ ডিসেম্বর রাতে চারিদিকে উৎসব। লাকি কাহিনি তখন গৌণ। ১০-১১ তারিখে শুনলাম বড়বোন, তার খালাকে দিয়ে কেস ঠুকেছে ছোট বোন আর প্রাক্তন টিউটরকে ফাঁসিয়ে। সবাই গ্রেফতার। অবশেষে নির্বাচনের কিছু আগে দুই পরিবারে রফা হলো। তবে নাবালিকা বলে লাকি আর বৌ হতে পারলো না। শালীত্বে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। থাবা শান দিতে দিতে অপেক্ষা করতে থাকলো সাবালিকাত্বের। এর সাড়ে তিন বছর পরে, তখন তেজগাঁ কলেজে পড়ি, শুনলাম লাকি নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছে, বোনের ননাসের জামাই অর্থাৎহেকমতের দুলাভাইকে ভাগিয়ে। এবার আর কাঁচা কাজ নয়। বছর ঘুরে কোলে ট্যাঁ ফোঁ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।
এটা অবশ্য ঠিক ছোটবেলার গল্প নয়। কৈশর পার হতে থাকা সময়ের গল্প। আঙ্গুলের ডগায় এলো বলে লিখে ফেললাম। ছেলেবেলা আরো পেছনে। তার গল্প লিখে ফেলবো কখনো। কবে জানিনা।
No comments:
Post a Comment