ঠিক কি পরিস্থিতিতে কোন অনুভুতি নিয়ে জেবতিক আরিফ সেদিন কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে ঐ পোস্ট দিয়েছিলেন, নিতান্তই ঠোসা না হলে শুধুমাত্র নির্দেশিত টানেল ভিশন ছাড়া সেটা না বোঝার কথা নয়। অশ্লীলতা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ নিয়ে ব্লগে গত দেড় বছরে কম ক্যাচাল হয় নি। কোন ইস্যুতে আক্রমণ হচ্ছে, তার কন্টেন্ট কি এটাই কিন্তু গোড়া থেকে মানদন্ড হিসেবে কাজ করেছে এবং সেটা অর্গানিক নিয়মেই করেছে। শর্তমুক্ত সমাবেশ হবার সুযোগ না থাকলে সামহোয়ার ইন ব্লগ বহু আগেই অক্কা পেত। অন্তত আমি থাকতাম না একথা হলফ করে বলতে পারি। গতবছর মার্চের শুরুতে মাসুদা ভাট্টির "তরবারির ছায়াতলে" মুছে দেবার পর এই ইস্যুতেই দুই দিন লেখা বন্ধ রেখেছিলাম। তাতে মাসুদা তার লেখা ফেরত না পেলেও একধরণের নৈতিক বিজয় হয়েছিল। যে কারণে গত একবছরে ব্লগ কর্তৃপক্ষ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি। গান্ধীপোকা, মুক্তচিন্তা, টোকাই বা মরশ,হারাধনদের ব্যান করায় কেউ অখুশী হয়নি কারণ সেখানে কন্টেন্টের বিষয়ে দ্বিমত ছিল না।গত সপ্তাহে আরিলের নামে একটি পোস্ট এসেছিল সাধু আচরণ বিষয়ে। সেই পোস্টটা গত কয়েকদিন ধরে খুঁজে পাইনি। সার্চ দিলেও আসে না। সেখানে অনেকের সাথে আমারও মন্তব্য ছিল। বলেছিলাম যে অশ্লিলতা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ বিষয়ে ধোঁয়াটে অবস্থান নেওয়াটা ব্লগের ভবিষ্যতের জন্য ভালো নাও হতে পারে। কারণ ভালোমানুষের ভাব নিয়ে মানবতাবিরোধী অবস্থানের পোস্টের প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে আলাদা করতে ব্যক্তিগত আক্রমণের সুনির্দিষ্ট সূচক নির্ধারণ কার প্রয়োজন। সহব্লগার চোরের মন্তব্যে বিষয়টা আরো অনেক স্পষ্টভাবে এসেছিল। এই সুনির্দিষ্ট সূচক নির্ণয় বিষয়টা একটা পর্যায়ের পরে বিমূর্ত চেহারা নেয়। তখন আর সেটা সরল ছাঁকুনিতে আলাদা করা যায় না। তখন আক্রান্তকে ব্যক্তিগতভাবে সেই লড়াই চালাতে হয়। উদাহরণ হচ্ছে স্যাটায়ার। শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করা যায়নি হিংকেল বলতে চ্যাপলিন হিটলারকেই বুঝিয়েছেন। সমরেশ বসুর বিবর বা ভ্লাদিমির নভোকভের ললিতাকেও অশ্লিল প্রমাণ করা যায় নি।কথা শুরু করেছিলাম ব্লগের খোলা হাওয়া নিয়ে। শুরু থেকেই বিভিন্ন মতাদর্শীদের আগমণ এবং খোলাখুলি নিজের বক্তব্য দেবার সুযোগ, সামহোয়ারইন ব্লগের আজকের পরিচিতির মূল কারণ। মানুষের সমাজেই শুধু কৃত্রিম অসমতা রয়েছে। সমাজ সেখানে আক্রান্ত হয় রাষ্ট্রের নতুন নতুন অস্ত্রে। আক্রমণের সাথে প্রতিবাদের ভাষাতেও পরিবর্তন আসে। একসময় সমালোচনা কিংবা প্রতিবাদের অধিকারকেও আইনসিদ্ধ করা হয়। রাষ্ট্র বাধ্য হয় করতে। অনুমোদনে স্বভাবত:ই ম্যানিপুলেশন থাকে। তখন লড়াই হয় তার বিরুদ্ধেও। লড়াই করতেই হয়। কারণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যতটুকু আইনের বইতে লেখা থাকে তার পুরোটাই লড়াই করে আদায় করা। সেটা কোন অবস্থাতেই প্রাপ্তি না, অধিকার। সুতরাং বাস্তব জীবনে বিভিন্নভাবে নিজের কথা বলতে বাধা পওয়া মানুষ অবিরাম পথ খুঁজতে থাকে। চায়ের দোকান থেকে বিতাড়িত হয়ে খোলা মাঠে তারপর খোলা মাঠেও যখন রাষ্ট্রের কুচকাওয়াজে কোনঠাসা হয়ে পড়ে তখন ভাচুর্য়াল জগতে এসে পড়ে। এই জগতটিতে আসার ন্যুনতম ক্ষমতা নিম্ন-মধ্যবিত্তের নীচে সম্ভব নয়। বিশ্বায়নের কালোয়াতিতে এই শ্রেণীটিও কোনঠাসা মানুষের কাতারে পড়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে ব্লগিং এর জনপ্রিয়তার এটাই সম্ভবত সবচাইতে বড় কারণ। জেবতিক আরিফের মতো আমিও কম্পুকানা, তাই অন্যান্য গূঢ় কারণগুলো জানা নেই।জানামতে সামহোয়ার ইন ব্লগই প্রথম আদ্যপ্রান্ত বাংলা ব্লগ। যেসব ইংরেজী ব্লগে বাংলায় লেখা সম্ভব ছিল সেগুলোকে কিভাবে বাংলা ব্লগ বলা যায় তা বলতে পারবো না; সেটা জানতে হাবিব মহাজনের শরণাপন্ন হতে হবে। বাংলা ব্লগে স্বভাবত:ই বাঙালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। তাদের মধ্যে আবার পশ্চিমবঙ্গের কিছু ব্লগার বাদে দুই তৃতীয়াংশের বেশী বাংলাদেশের নাগরিক। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনসমাজে চলতে থাকা বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের উপস্থিতি সেখানে অবশ্যম্ভাবী। প্রান্তিক জনসমাজ সর্বাত্মক শোষণের কারণে তার তাবৎ চৈতন্য জুড়ে লড়াই ক্রিয়াশীল থাকে। ব্লগের খোলা মাঠে তার প্রকাশ ঘটবেই। প্রকাশ আটকে দেওয়া হলে নতুন মাঠের সন্ধানে যেতে হবে। অথবা লাঠিয়ালের সাথে লড়াই চলবে। গায়ে আঁচড় না লাগা সুশীলের কাছে দৃষ্টিকটু হলেও বিষয়টা এরকমই। বাংলাদেশ সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের ধারাবাহিকতা বলে তার সশস্ত্ররূপে বিরতি এলেও সংগ্রাম পরিবর্তিত চেহারায় বর্তমান। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ৩৬ বছরের রাজনৈতিক মতলববাজী মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাষ্ট্রের আইনে হালাল ঘোষনা দিলেও যুদ্ধের স্মৃতি গণচৈতন্যে বর্তমান। ভোটের রাজনীতির ফাটকাবাজীতে এই চৈতন্যের দেখা পাওয়া মুশকিল। জনগণের বিশেষত: প্রান্তিক জনগোষ্ঠির স্বত:স্ফুর্ত সংগঠিত প্রতিরোধের চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এখানে আঘাত এলে প্রতিবাদ হবেই। সেই প্রতিবাদে তীব্রতাও দেখা দেবে বিভিন্ন চেহারায়। ব্লগ কথা বলার জায়গা। এখানে কথার প্রতিবাদ কথায় হয়। রাজনৈতিক মতলববাজীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের উপস্থিতি এবং মতপ্রকাশ হালাল বলে তারাও এখানে লেখেন। তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তারা ব্যবহার করেন পূর্ণমাত্রায়। আক্রমণও করেন যথেচ্ছ। এই আক্রমণের জবাব আরো আক্রমণাত্মক না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই অধিকারে যদি হস্তক্ষেপ হয় সুশীল আচরণের মায়াকান্না কেঁদে তাহলে সেই মায়াকান্নার মুখোশেও জনগণের হাত চলে যাবে এ আর বিচিত্র কি?
৩০ এপ্রিল ২০০৭, সামহোয়ারইনব্লগে প্রকাশিত
৩০ এপ্রিল ২০০৭, সামহোয়ারইনব্লগে প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment