Sunday, October 12, 2008

টুকরো টুকরো লেখা ৫



ভাবছিলাম খুব মন খারাপ করা একটা পোস্ট ছাড়ুম। কিন্তু বঙ্গপুঙ্গবের দল সেই চান্স দিলো না। তখনো রান বাকি গোটাকুড়ি। ঘরের মধ্যে নাচলাম কতক্ষণ। পাশের ঘর থিকা গালিভারনী গলা হ্যাকরানি মারে। কিন্তু তখন ওকে শোনার টাইম নাই। হঠাৎ আয়নার মুখে পড়তে মন আবার খারাপ হতে ধরলেও ঠিক তক্ষনই সাকিব মিয়া উইনিং রান নিয়া আমার নাচের গতি বাড়াইয়া দিলো।

১.

ঘটনাটা শোকেরই। চারবছর লালন পালন কইরা তার লাশ টুকরিতে ফিক্কা ফালানোর মতো শোক আর দুনিয়ায় কয়টা আছে?

আমি আর নাই সে আমি।

মাথাটা ফুঁ দিয়া ফুলানো প্লাস্টিক বলের মতো লাগে। আয়নার দিকে চাইলে এক বিপর্যস্ত কাকতাড়ুয়ারে দেখতে পাই। কাকহাসুয়াও বলা যাইতারে। মনে হয় ডজন খানেক কাক আমার আড়াআড়ি সমান্তরালে বইসা গত আড়াই ঘন্টা যাবৎ বি-ফ্ল্যাটে কোরাসে হাসতেছে। কোন রকম তাল কাটাকাটি নাই।

২০০৪ সালের ৮ আগস্ট সকাল এগারোটার দিকে শেষ বার। তারপর এই চাইরবছর দুইমাস একদিন ধইরা বড় করা চুল কোরবানি দিলাম ঠিক বাংলাদেশ যখন একটু একটু কইরা রানরেট বাড়াইতেছে তখন। আসার সময় পকেট থিকা হেয়ার ব্যান্ড বাইর কইরা ডাস্টবীনে ফালাইলাম।

একটা যূগ শেষ হইলো। আবার কবে এমন ঝুটি বান্তারুম বা আদৌ পারুম কীনা ইবলিসেও জানে না।

২.

গত পৌনে তিন সপ্তাহে গোটা তিন জার্মান ছবি দেখলাম। তিনটা তিন মেজাজের ছবি। আমি বরাবরই জার্মান ছবির ভক্ত। তবে যেগুলি ছবি ওরা হলিউডের নকল কইরা বানাইতে গিয়া ধরা খায় সেগুলি না। যেগুলি ছবি হাউস ফুল চলে ছোট ছোট অডিটোরিয়ামে, সেগুলি। দু:খজনকভাবে সেগুলি দেখতে গেলে একইসাথে জার্মান ভাষা জানতে হয় আর রুচি খানিকটা ভালো হইতে হয়। এইখানে রুচি ভালো হওয়া বলতে রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কিছু প্রাইমারি ধারনা থাকারে বুঝাইছি। আর একটা ব্যারিয়ার আছে। সেইটা হইলো মিইউমজা অর্থাৎমিলিটারি-ইউনুস-মজহার-জামাতের ভক্তরা কোনদিনই আমার সাথে তাদের ফিলিমের টেস্ট মিলাইতে পারবে না। প্রতিটা লোকেরই সীমাবদ্ধতা থাকে। আমারো আছে। আর সেইখানে আমি মৌলিক ঘাউড়া। যেহেতু এই বিষয়ে আমার মতের বাইরের পাবলিকে ঘাউ ঘাউ করলে আমি চুপ থাকি, সুতরাং এই পয়েন্টে আমারে এলিটিস্ট বলার তেমন চান্স আছে বইলা মনে করি না। আমি মনে করি একজনের জেমস বন্ড দেইখা আনন্দিত হওয়ার অধিকার যতটুকু , জেমস বন্ডরে প্রতিক্রিয়াশীল প্রোপাগান্ডা বলার অধিকার আমার ঠিক ততটুকু। কেউ র্যাম্বো দেইখা মজা পায় কেউ ফুল মেটাল জ্যাকেট দেইখা মজা পায়। এইখানে আসলে ডাইভারসিটি মাইনা নেওয়াই উত্তম। পাশাপাশি আবার রাজনীতিতে সব সময় এই ডাইভারসিটি আমি মানি না। কারণ সেইটা হাতে কলমে মাঠে বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত। সেইখানে যারা র্যাম্বোর রাজনীতি সমর্থন করে তাদের ব্যাপারে আমি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মাথায় পিস্তল ঠেকানোর মতো চিপায় না পড়লে মানি না। কারণ যা ফুল মেটাল জ্যাকেটে দেখানো হইছে সেইটা ইতিহাস। যা র্যাম্বোতে দেখানো হইছে সেইটা মার্কিন রাজনীতির জঘন্য ইতিহাস জালিয়াতী। আমার মতে বৈশ্বিক ছাগলায়ন প্রক্রিয়ার অংশ।

এইবারের কেইস একটু অন্যরকম ছিলো। কাসেলের সবচাইতে বড় বা প্রধান সিনেকমপ্লেক্স সিনেস্টারে জার্মান চলচ্চিত্রের উৎসব শুরু হইছে। একই সাথে আরো কয়েকটা হল থাকলেও সিনেস্টারই এই উৎসবের আসল জায়গা। পুরা হাউসে টোটাল ১৩ টা অডিটোরিয়াম। কোনটাই খুব বড় না। মানে আমাদের মতো রিয়ালস্টলডিসি এই সব নাই। অডিটোরিয়ামের চেহারায়ও কোন আলাদা জেল্লা নাই। কিন্তু কোয়ালিটি বোঝা যায় ছবি শুরু হওয়ার সময়। অসাধারণ সাউন্ড কোয়ালিটি। আমি ভারতেও কিছু হাইফাই হলে ছবি দেখছি। যেগুলার বসার ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে জার্মান সিনেমা হলরে ফকীর মনে হবে। কিন্তু ছবিশুরু হইলে কান ফাইটা যায়। কোন কারণে উপমহাদেশের বাণিজ্যিক হলমালিকদের ধারণা আওয়াজ যত জোরে হবে লোকের কাছে টেকনিক্যাল সাপোর্ট ততবেশী পাওয়া গেছে বইলা বাহবা পাওয়া যাবে। স্বদেশের কথা আর আলাদা কইরা বললাম না। ভুক্তভোগী বোঝেন। জার্মানীতে আসা অব্দি মিউনিখে, গোয়টিঙ্গেনে আর কাসেলে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয়েছে। সব জায়গাতেই এক অভিজ্ঞতা। প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট বোঝা যায়, কিন্তু কানে বাড়ি মারে না। ঠিক যতটুকু দরকার ততটুকু।

অনেক অপ্রাসঙ্গীক কথা বলতেছি। এর কারণ সম্ভবত: এই প্রসঙ্গগুলিতে আমার একান্ত নি:সঙ্গতা। চারবছর হইল প্রায় কাসেলে, এমন কোন বন্ধু পাইলাম না যারে অন্তত প্রস্তাব দেয়া যায় যে চল অমুক ছবিটা দেইখা আসি। এই পর্যন্ত যা দেখা হইছে দুয়েকটা বাদে সবই একা।

৩.
গত মাসের শেষ দিকে মনটন খুব খারাপ। উদ্দেশ্যবিহিন হাঁটতেছিলাম শহরে। সিনেস্টারে গেলাম মুততে। গিয়া দেখি এই চলচ্চিত্র উৎসব শুরুর ঘোষনা। সামনে বিরাট পোস্টার [b]"ডেয়ার বাডার মাইনহফ কমপ্লেক্স"[/b] সাথে সাথে দ্বিতীয় চিন্তা না কইরা টিকিট কইটা ফালাইলাম। আন্দ্রেয়াস বাডার আর উলরিখ মাইনহফ নাম দুইটা ঐতিহাসিকভাবে আমার খুব চেনা। ১৯৬৮'র ছাত্র আন্দোলন থিকা শুরু। ১৯৬৯ সালে এসপিডি (Sozial-Demokratische Partei Deutschlands অর্থাৎ Social-Democratic Party of Germany)ক্ষমতায় বসার পর ভিলি ব্রান্ডট্ পলিটিক্সে আন্দোলন ঝিমাইয়া পড়ে। সেই সময়কার অ্যাক্টিভিস্টদের একটা অংশ তখন সারেন্ডার না কইরা সশস্ত্র বিপ্লবের লাইন নেয়। এদের নাম ছিল "রেড আর্মি ফ্র্যাকশান"(RAF). স্বভাবতই এরা ব্যর্থ হয়। যেই কারণে নকশাল আন্দোলন ব্যর্থ হয় মোটামুটি সেই একই কারণে এরা ধরা খায়। কিন্তু একটা সময়রে একটা প্রজন্মরে ঝাঁকি দিয়া এরা অন্নপ্রাশনের ভাতশুদ্ধা নাড়া দিতে পারছিল। এদের সমর্থক যাতে না বাড়ে সেই জন্য পুরা সত্তর দশক ধইরা জার্মানী আর ফ্রান্সে মধ্যপন্থী "প্রগতিশীল"রা পুঁজিবাদের সাথে দৃশ্যত: অসামঞ্জস্যপুর্ণ অনেকগুলি আইন করতে বাধ্য হইছিল। এদের সাথে মতৈক্যে যাওয়া না যাওয়া তর্ক সাপেক্ষ বিষয় কিন্তু ইতিহাসে এদের অবস্থান অস্বীকার করা এক ধরণের জালিয়াতীই।



ছবি শুরু হইছে ১৯৬৮ তে ইরানের তখনকার শাহ রেজা খান পাহলভীর ড্রইংরূম বিলাসীনি বৌয়ের পশ্চিম বার্লিন সফর দিয়া। বামপন্থী ছাত্রদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে গুলি চালালে নিহত হন বেনো ওনেযর্গ নামে এক ছাত্র।


এই ঘটনা ১৯৬৮র ছাত্র আন্দোলনরে রীতিমতো এপিকের পর্যায়ে নিয়া যায় জার্মানীতে। তারপর ধারাবাহিক ভাবে ইতিহাস অনুসরণ করতে করতে একেবারে ১৯৭৭ সালে জেলের ভিতর RAF নেতাদের আত্মহনন পর্যন্ত। কোন মন্তব্য নাই। কোন উপদেশ নাই। শুধু ইতিহাস। লাশগুলি বাস্তবে ঠিক যেইভাবে পইড়া ছিল, স্ক্রীনেও ঠিক তাই দেখা গেল। তারপর বব ডিলানের Blowin' in the windদিয়া শেষ।


দুর্দান্ত স্ক্রিন প্লে। অসাধারণ অভিনয়। মার্টিনা গেডেক, ইয়োহানা ভোকালেক আর মরিৎস ব্লাইবট্রয় লাজওয়াব ছিলেন। সেই সাথে বাকি যাদের নাম জানিনা তারাও।

[url=http://kino.to/]পুরা ফিলিমের লিঙ্ক দিলাম। যারা জার্মান জানেন তারা দেখতারেন[/url]

৪.

ছবি দেখে বাড়ি ফেরার সময় অনেক কথা মনে হচ্ছিল। রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে নগ্ন মিথ্যাচার করা সিনেমা বানাতে হলিউডিবলিউডি ধোনকুবেররা গত পয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে টনকে টন ডলার ঢেলেছেন। ষাট-সত্তর দশকের সেইসব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরাই আবার পরে পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে জেমসবন্ড-র্যাম্বো-ফায়ারফক্সের মতো জঘন্য প্রতিক্রিয়াশীল ফিল্ম গোগ্রাসে গিলেছেন। সাড়ে তিনদশক পেরিয়ে আজকের প্রজন্মের কথাবার্তায় স্পষ্ট বোঝা যায় সাম্রাজ্যবাদ তাঁদের প্রোপাগান্ডায় সফল। বিপরীতের ছবিগুলি অযত্ন আর অনর্থক আঁতলামীতে ভরা। কিউবায়, ভিয়েতনামে আর বাংলাদেশের গণযুদ্ধে অন্তত তাৎক্ষণিক বিজয়ী জনতার বীরত্বগাঁথা কেন্দ্র করে সেভাবে কোন কিছুই হয় নি। এই ব্যাপারে শুধু জনগণ জনগণকে নায়কের ভুমিকায় দেখতে চায়না জাতীয় উত্তরাধুণিক বাখোয়াজ তুলে কিছু মতলববাজ কৌশলে মিথ্যা ইতিহাস হালালের প্রক্রিয়ায় নাম লিখিয়েছেন। অথচ যাদের হাতে বিপরীত সিনেমা নির্মানের অর্থ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা অন্তত পরবর্তী বছর পনের থেকেছে, তাদের দিক থেকে যে কোন রকম চেষ্টা চালানো হয় নি, এই কথাটা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। সঠিক অর্থে কোন অ্যাকশান ছবি হয়নি মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। নকশাল আন্দোলন নিয়ে তো দুরস্থান। যদিও ঠিক ঐ সময়টাতে ফ্রান্স-জার্মানীর তুলনায় অনেক অনেক বড় অনেক বেশী র্যাডিক্যাল গণজাগরণ ঘটেছে এশিয়ায় আর দক্ষিণ আমেরিকায়। সেইসব আন্দোলনের বাস্তব সামাজিক ভিত্তি এবং বিপ্লবীদের আত্মদানও ঐসময়কার ফ্রান্স-জার্মানীর ছাত্র আন্দোলনের চাইতে অনেক অনেক বেশী শক্তিশালী।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকি। কেউ না কেউ হয়তো করবে কখনো। কিংবা হয়তো করবে না......

No comments: