১.
আর মাত্র চারদিন। আগামী রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানীর সতেরতম সাধারণ নির্বাচন। মনুষ্যসমাজের আর দশটা নির্বাচনী রাজনীতিভিত্তিক রাষ্ট্রের মতো জার্মানীতেও সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচনী রাজনীতি সম্পর্কে একধরণের সাধারণ হতাশা বিরাজ করে। সাধারণ মানুষ বলতে অবশ্যই নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলছি। জার্মান নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী পুঁজিবাদী বিশ্বে বৃহত্তম না হলেও বৃহত্তমদের অন্যতম বলা যেতে পারে চোখ বুঁজেই। তবুও শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের নিয়মে খেটে খাওয়া দরিদ্ররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। নির্বাচনে এদের অংশগ্রহণ এক ধরণের ঐচ্ছিক পিকনিকের মতো। ভোট দিলে দিলাম না দিলে নাই দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো খেটে খাওয়া মানুষেরা নির্বাচনকে দেখে থাকে। যে কারণে জন্যসংখ্যার খুব বড়ো একটা শতাংশ ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করে না।
মোটামুটি সারা পৃথিবীর ভোটের রাজনীতির গড়পড়তা হিসাব এরকমই। নির্বাচনী রাজনীতির চানাচুর আলাপে আগ্রহ দেখা যায় খবরের কাগজের পাঠক আর রেডিও-টেলিভিশনের দর্শক শ্রোতা শ্রেণীর বৃহত্তর অংশের কাছে। এঁদের মধ্যে নিচের দিকে আছেন নিয়মিত-অনিয়মিত পেশাজীবিরা, আছেন নিয়মিত শ্রমিকেরা অর্থাৎ এখনো যারা চাকরি খোয়ান নাই, আছেন সদ্য চাকুরি খোয়ানো বেকারভাতা প্রাপ্তরা, আছেন চিরদিনের অস্থায়ী শ্রমিকরা আর বিশাল সংখ্যার তালিকাবহির্ভূত শ্রমিকরা। এরপর নিচ থেকে উপরের দিকে উঠতে উঠতে ভার্টিগো রোগাক্রান্তদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নির্বাচনী রাজনীতির গলাবাজী আর্থ-সামাজিক বিভাজন সাপেক্ষে এখানে বিভাজিত চেহারায় বিরাজ করে। জার্মান রাজনীতি, ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে হেজিমনিক অবস্থান থেকে দেখা বিশ্ব রাজনীতির পরস্পরবিরোধী বিশ্লেষণী চিত্রগুলি এদের অবস্থান থেকেই আসে। নিরপেক্ষতার মতো পবীত্র পারিভাষিক অবস্থান সেখানে অনুপস্থিত। এদের একজন হিসাবে জার্মান নির্বাচনের প্রাক্কালে কয়েক দিনের খানিক নির্বাচনী কচকচির উদ্দেশ্যে বর্তমান সিরিজ শুরু করলাম।
২.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী চার দশক ধরে কল্যাণমুখী পুঁজিবাদের পরাকাষ্ঠাধারী জার্মান মডেল সামজতন্ত্রী নিন্দুকদের মুখে ঝাঁটা মেরে বিশ্বকে দেখিয়েছে, পুঁজিবাদী অবকাঠামোর ভেতরেও রাষ্ট্র কীভাবে উচ্চ মজুরি, জীবনযাত্রার উন্নততর মান এবং সার্বজনীন সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে। ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের প্রতিদ্বন্দ্বি পূর্ব জার্মানীকে আত্মস্থ করাকেও নব্বুই দশকের শুরুতে জার্মান মডেলের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। নতুন শতাব্দী শুরু হতে হতে নব্বুই এর শেষ নাগাদ তাতে সংশয় দেখা দিতে শুরু করে গত সাত বছরে ক্রমশ গাঢ়তর সঙ্কটের মুখ দেখছে। দীর্ঘদিন অতিউচ্চ উৎপাদন মাত্রায় বিচরণ করার কারণে ত্রাহি ত্রাহি হাল না হলেও ক্রমবর্ধমান শ্রমিক ছাটাই, কর্মঘন্টার অনুপাতে মজুরি হ্রাসের ঘটনাগুলো প্রান্তিক সামাজিক শ্রেণীকে ইতিমধ্যেই নাড়া দিয়েছে। এই নাড়া দেবার মাত্রা বাংলাদেশের মতো দারিদ্রসীমার বাইরে থাকা প্রাক-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে সুড়সুড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদনের ধ্রুপদী প্রাণকেন্দ্র, ভারীশিল্পে অতিদীর্ঘকাল একচেটিয়া উপভোগকারী জার্মানীর প্রাণ সঙ্কট তৈরী করছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আশঙ্কাটি অমূলক হবার সম্ভাবনা হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবুও বিষয়টি এই মুহুর্তে পশ্চিম ইউরোপের অন্তত অ্যাকাডেমিক সারফেইসে বহুল আলোচিত।
১৯৪৯ সালে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানী জন্ম নেয় ভাইমার রিপাবলিকের মার্কিন,বৃটিশ আর ফরাসী দখলে থাকা জমিনে, বলা যায় প্রুশিয় সাম্রাজ্যের শিল্পোন্নত এলাকার প্রায় পুরোটা নিয়ে। জার্মান সোশাল ডেমোক্র্যাসীর মডেল তৈরীর মৌল উপাদান ছিল খৃষ্টীয় গণতন্ত্র(!) বা তথাকথিত ট্র্যাডিশনালিজমের সাথে তখনকার বাকি দুই আধুনিক প্রতিদ্বন্দ্বী পুরো পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের একধরণের আপোষরফা। এই আপোষরফার বিপরীতে ছিল দীর্ঘদিন কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শ্রমিক আন্দোলন। জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দাপটের কারণে ২য় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী জার্মান রাজনীতিতে দীর্ঘদিন মধ্যবিত্ত আর শ্রমিক শ্রেনী ছাড়া আর কারো অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। বিশেষ করে, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব-লবি ইত্যাদি থাকলেও সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না। রাজনীতিতে ধর্মের নামনিশানাও ছিলনা ভাইমার রিপাবলিক এবং জাতীয় সমাজতন্ত্রী জার্মানীতে। মার্কিন-বৃটিশ-ফরাসী নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম জার্মানী ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের এবং ১৮৪৮ সালের বেয়াদব বিপ্লবীদের শায়েস্তা করতে গণতন্ত্রের আগে একখানা ক্রিশ্চিয়ান জুড়ে দিয়ে তৈরী করেন বর্তমান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। এর পর থেকে আমেরিকা-বৃটেনের মডেলে একটা উদার আর একটা রক্ষণশীল মডেলে অনেকদিন পর্যন্ত চলেছে উচ্চবিত্তের স্বস্তির স্বারক দ্বিদলীয় ভোটের রাজনীতি। কিন্তু উনিশ শতকের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক ভাংচুর এবং দুটো বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস শেষ পর্যন্ত জার্মান রাজনীতিকে অ্যাঙলো-স্যাক্সনদের ক্রিয়াবাদী সমাজের মতো স্বস্তিকর থাকতে দেয়নি। ক্রমশ রাজনৈতিক বিরোধ বিভাজনের ঊর্ধ্বগতি এখানকার রাজনীতিকে জটিল করে তুলতে থাকে। ১৯৯০ নাগাদ সমাজতান্ত্রিকব্লকের পতন এই জটিলতার অবসান ঘটাবে বলে অনেক সফেদ ছাগুর শিঙে যে আকাঙ্খা ঘুরপাক খাচ্ছিল সাবেক পূর্বজার্মানীর পৃথক বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়া কার্যত: ঐ জটিলতায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
৩.
এই জটিলতা সম্পর্কে একটা সাধারণ চিত্র পেতে গেলে জার্মান রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে একটা হুমেইডহু বয়ানের প্রয়োজন। আগামী কিস্তিগুলিতে সেগুলি আলোচনার ইচ্ছা থাকলো।
ছবি : ২০০৫ সালের ফলাফল .....কৃতজ্ঞতা গুগল
No comments:
Post a Comment