Wednesday, July 23, 2008

গল্প : : নির্বাণ

চার নম্বর ট্রাম ধরে যখন কোয়নিগস্ প্লাৎসে পৌঁছলাম তখন রাত সোয়া বারোটা। আমার ডেরা আর মাত্র দুটো স্টপেজ পরে। ট্রাম দাঁড়িয়ে থাকবে এখানে আরো পাক্কা দশমিনিট। খাওয়া হয়েছে ফাটাফাটি। রুইমাছ ভুনা, গরু ভুনা, উৎকৃষ্ট ডাল, পাঁচমিশালী সব্জি....রীতিমতো আকণ্ঠ খাওয়া যাকে বলে। শরির ছেড়েই দিয়েছিল। শেষ ট্রাম মিস করার ভয়ে ধুপধাপ নেমে আসতে হয়েছে। ট্রামে জায়গা পেয়েছি মুখোমুখি চারজনের সীটে। ভুড়িটাকে সীটের সাথে পয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে রেখে বসে আছি প্রায় কুড়ি মিনিট। এখানে ট্রাম বদলাতে নামতেই হবে। ধীরে সুস্থে উঠে বাইরে এলাম। এক নম্বর ট্রাম সামনেই দাঁড়িয়ে। উঠবো? বাতাসটা ভালো লাগছে। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ১৪‍° সেন্টিগ্রেড। হাঁটি। হেঁটে বাড়ি ফিরতে গদাইলস্করী চালে পনের মিনিট, হন্ হন্ করে আট মিনিট।

ওবারমাইয়ার নামে একটা বেশিদামী জামাকাপড়ের দোকান ছিল এখানে। কিছুদিন আগে তারা পাততাড়ি গোটানোয় ওখানে এখন অনুর্ধ ১০ ইউরো মূল্যমানের দোকান। তারপর একটা চুলকাটার দোকান। দিনের বেলা সেখানে বাইরে থেকে উত্তেজিত বালিকাদের কাঁচি হাতে তৎপর দেখা যায়। তারপর ফার্স্ট ফুডের দোকান পেরিয়ে ডান দিকে একটা চিপা গলি। সেখানে একটা ইতালিয়ান রেস্তোরা আছে। ভাবসাব দেখে বোঝা যায় অন্তর্বাস বন্ধক রেখে আসতে হবে ওখানে পালং শাক চচ্চরি খেতে গেলে। গলির মুখ পেরিয়ে ইজিক্রেডিট নামে কোনএক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠাণ, তারপর চিবো'র ছোটখাটো ক্যাফে, তারপর এক সর্দারজীর দোকান। সেখানে শুধুই রমনীয় আভরণ, বিশেষত: অন্তর্বাস বিক্রি করা সর্দারজী বেশ হাসিখুশী লোক। সর্দারজীর দোকান পেরিয়ে আরো একটা গলি আর তারপর একটা বেয়াটেঊযে(Beate Uhse) নামের বিশ্বখ্যাত দুষ্টুবিপণী। রাত যতই বাড়ুক এর বাইরে সর্বদা কিছু নিরব তামশগীরকে ইত:স্তত ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। বাইরের ডিসপ্লেতে এবারের রেপ্লিকাটা জমেনি। গতবারের আগেরবার ক্রিসমাসেরটা ভালো ছিল। স্টেয়ার্ণের মোড়ে এসে সিগনালে হাত দিলাম। লাল বাতি জ্বলে আছে। গাড়ি রাস্তায় নেই বললেই চলে। তারপরো দাঁড়িয়ে থাকি। তাড়া নেই। বাড়ি গিয়েই বালিশে মাথা দেবো।

স্টেয়ার্ণ পার হতেই চাপটা টের পেলাম। রাস্তার ওপারে শ্লেকারের সামনে এসে একবার বুকভরে শ্বাস নিলাম। অনেক সময় কাজে দেয়। কিসের কি? মনে হলো একটা বড়ো মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি.....বহুদূর থেকে ঢাকের বাদ্য শুনতে পাচ্ছি। বাড়ি পৌঁছতে কমপক্ষে আরো পাঁচ মিনিট। পা চালাই। বিপত্তি বাড়তে থাকে। থামা চলবে না। টুপির দোকানের সামনে একটু থামতে গিয়ে কেঁপে উঠলাম। এবার ঢাকের সাথে করতাল যোগ হল। ...মিঠুনের প্লেব্যাকে কিশোরকুমারের গান....ও দাদুরে ...দেখলে কেমন তুমি খেল...চট করে আবার তাল বদলে....ঢোল বাজে ঢোল বাজে ঢোল বাজে ঢোল!...ঢাম ঢাম বাজে ঢোল....কোনছবির গান?...হ্যা...মনে পড়ছে.....হাম ঢিল দেচুকেসানাম। এইজায়গায় রাস্তাটা ঢালু। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জুতার ভেতরে পা...তার গায়ের মোজা ভিজে চুপচুপ করছে টের পাচ্ছি। গোড়ালি থেকে খানিক উপরে হাঁটুর নিচে মাসল্ কামড়াচ্ছে। কাঁধ কামড়াচ্ছে। শ্বাস নিতে ভয় পাচ্ছি। হন্ হন্ হেঁটে পার হতে চেয়েছিলাম। হপলা'য় এসে আবারো সিগন্যাল। দাঁড়ানো খুব বিপজ্জনক। লাল বাতি জ্বলেই আছে বোকার মতো। সোজা হাঁটা দিলাম। যা হয় হবে। ঠিক পেছন দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। জানালা দিয়ে এক ছোকরা মধ্যমা দেখালো। আমি সোজা হাঁটি। মাথা চক্কর দিচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছি। মুক্তমঞ্চের সামনে এসে পকেট হাঁতড়াই। চাবি কৈ? না আছে । চাবি হাতে নিয়ে এগোতে থাকি। সামনে প্রতিবন্ধক। মেরামত চলছে। আকাশে ফাটল ধরতে শুরু করছে। বেশী লম্বা কদম বাড়াতে পারছি না। ঘুরপথে আসছি। ডিপার্টমেন্টের সামনে হাউজ মাইস্টারের শেফার্ডটা বসে আছে। আমাকে তেমন ভালোবাসে না। গড়গড় করছিলো হয়তো। হয়তো না। জানিনা। আরো প্রায় তিরিশ কদম। চোখের পাতা ঘেমে যাচ্ছে। একফোঁটা ঘাম গড়িয়ে গাড়িয়ে দাড়ির অরণ্য পেরিয়ে গলার ভাঁজে এসে থামলো মনে হয়। দরজায় ধাক্কা খেলাম। চাবি ঢুকছিল না। কানের দুপাশে দুটো ঢাক বাজছে। করতালে বাড়ি পড়ছে দু চোখের মাঝামাঝি খুলির ভেতরের দিকে কোথাও। সিড়ির সুইচ টিপতে দেখি বাতি ফিউজ। ধাপগুলি একেকটা শতাব্দীর মতো...........

মিনিট তিরিশেক পরে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙি। ফ্লাশের অনুপ্রাসে ক্রমশ হারিয়ে যায় চৈত্র সংক্রান্তির পালা।

No comments: