Wednesday, July 23, 2008

জাহাঙ্গীরনগরের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ১৯৯৮ (রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট)

এক কিস্তিতে শেষ করতে পারবো কিনা জানিনা । আর আমার চাইতে বেশী করে এবং কাছ থেকে যারা আন্দোলনকে দেখেছেন তারা আরও ভালো বর্ণনা করতে পারতেন । এই ব্লগে দুজনকে চিনি যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল । তারা হয়তো কখনও আলাদা পোস্ট করে বা নিদেন পক্ষে সম্পুরক মন্তব্য দিয়ে আমার অস্পূর্ণতাকে মেরামত করতে পারবেন । আমি রাজনীতি না করায় এবং জার্মান শিক্ষার্থে দুপুরের বাসে ঢাকায় চলে আসায় আমার অংশগ্রহণ ছিল ছাড়া ছাড়া । আর বন্যার জন্যে ভার্সিটি বন্ধ করে দেওয়ার পরে বাসায় চলে এসেছিলাম ।তাই অনেক কিছুই আসলে মিস করেছি । তবুও দেখা এবং শোনা মিলিয়েই প্রত্যক্ষ । তাই এটা নিয়ে লিখবার সাহস করছি । সেই সময়কার নেতৃস্থানীয়দের কেউ আমার লেখা পড়লে শুধরে দেবেন অবশ্যই । তবে কোন দলের অংশগ্রহণ ছিল , কোন দলের ছিল না এই বিষয়ে আমাকে শুধরে দেওয়ার কিছু নেই । কারণ সেখানে আমার জ্ঞান অনেক বেশী পরিস্কার ।আসলে ধর্ষণের মত নারী নির্যাতনের ঘটনা সর্বত্রই ঘটে । জাহাঙ্গীরনগরের সাধারণ ছাত্রদের প্রতিরোধের কারণেই বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় এসেছে। এই প্রতিরোধের জন্যে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র হিসেবে আমি গর্বিত। ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রতিবাদ করার প্রকৃত উদাহরণ পাওয়া যায় শ্রমজীবি মানুষদের মধ্যে। মধ্যবিত্তের প্রবণতা হচ্ছে চেপে যাওয়া । জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলনটি মধ্যবিত্তের আন্দোলনই ছিল। তাই দীর্ঘ দিন চেপে রাখার পরে বিস্ফোরিত হলেও মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতা কে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। এতে যতটুকু ব্যর্থতা ছিল তার পুরোটাই মধ্যবিত্তের ঠুনকো প্রগতির সীমাবদ্ধতার কারণে। সেই সীমাবদ্ধতা কিভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। শুরুতে সেইসময় জাহাঙ্গীরনগরের রাজনীতির প্রেক্ষাপট বলা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মাস ছয়েকের মাথায় ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ দখল করে নেয়। এই দখল মোটামুটি দখলের সাধারণ নিয়মানুসারেই হয়েছিল। ছাত্রদলের একাংশ পালালো আর জুনিয়রদের একাংশ জয় বাংলা বলে পিঠ বাচালো । মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই জাহাঙ্গীর নগরের রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে ছাত্রলীগের সাথে বামপন্থীদের দ্বন্দ্ব কে ঘিরে। এমনকি যে ছাত্র ইউনিয়ন যূগ যূগ ধরে লীগের লেজ ধরে জীবন ধারণ করে আসছে তারাও জাহাঙ্গীরনগরে লীগ বিরোধী হতে বাধ্য হয়েছে । ৪-৫ টি বাম সংগঠন, নারীবাদীদের বিভিন্ন সংগঠন এবং জাহাঙ্গীর নগর সাংস্কৃতিক জোট এরা সম্মিলিত ভাবে বরাবরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে গেছে । বৃহত্তর ঐক্য হয়েছে কেবল মাত্র শিবির ইস্যুতে এবং সেখানে ছাত্রদলের বৃহত্তর গ্রুপটি সবসময়েই বামপন্থীদের সঙ্গে গলামিলিয়ে শিবির বিরোধী আন্দোলন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে ছাত্রলীগের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাওয়ার পর থেকে ছাত্রলীগ আর সাংগঠনিক ভাবে সোজা হতে পারেনি । এই দলীয় চেহারার বাইরে অন্য আর একটি ফ্যাক্টার সেখানে কাজ করে । স্থানীয়-অস্থানীয় দ্বন্দ্ব । ১৯৯১-৯৬এ বি.এন.পির সময়ে এই দন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে । জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলে সেই থেকে লোকাল-অ্যান্টি লোকাল বিরোধীতা স্থায়ী চেহারা নেয় । ছাত্রলীগের দখল প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম তারা যে সমস্যায় পড়ে, ছাত্রলীগের কোন লোকাল ফ্র্যাকশান ছিল না। যারা জয় বাংলা বলে দখলের সময়ে ডিগবাজী দেয় তাদের বেশীর ভাগই ছিল ছাত্রদলের লোকাল গ্রুপের। যারা শিবির আক্রমণের সময়ে তাদেরকে সহায়তা করেছিল। এরা ঐতিহাসিক কারণেই উগ্র ধরনের অ্যান্টি বাম অবস্থানে ছিল। এদের সঙ্গে ছাত্রলীগের মধ্যকার অ্যান্টিবামদের একধরনের সমঝোতা তৈরী হয়। এর ফলে আগে বি.এন.পি.র আমলে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ডকে কেন্দ্র করে লীগের সাথে বাম সংগঠণগুলোর যে ঐক্য তৈরী হয়েছিল তা কিছুদিনের মধ্যেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় । দখলের রাজনীতিতে যেটা হয় লীগ আসলে দল নাই বা দল আসলে লীগ নাই ধরনের একটা অবস্থা। তো ঐ সময়ে দলের অ্যাক্টিভ গ্রুপটি অনুপস্থিত বা নিষ্ক্রিয় ছিল। সুতরাং প্রকাশ্যে বিরোধী দল বলতে তিনটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠণ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট আর ছাত্র ফেডারেশন । ছাত্রলীগের হার্ড লাইনার রা মানে মূলত ছিচকে চোর মানসীকতার পোলাপানরা গোড়া থেকেই চড়াও হয় একাধারে বাম ছাত্র কর্মী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠণ গুলোর উপরে। পুরনো সাসপেক্টেড শিবিরের অনেক পোলাপানকে ঐ সময়ে জেনে শুনে হল কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়। আর তখন জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সথে জামাতের দহরম-মহরম চলছে। আঞ্চলিক রাজনীতির যাবতীয় টাকা-পয়সা হাতাতে ছাত্র লীগের সামনে তখন এছাড়া হয়তো কোন পথও ছিল না । লোকাল বলতে যাদের বোঝায় তারা আজন্ম মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হলেও "টেকার গন্ধ" সবাইকে এক পতাকার নীচে নিয়ে আসে। তবে ছাত্র লীগে কিছু হতভাগা শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল যারা মুক্তিযুদ্ধজনিত আবেগ ছাড়তে পারেনি। তারা ১৯৯৭ জুড়ে নানাভাবে চেষ্টা চালায় দলের নেতৃত্বে এসে পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে। কিন্তু কেন্দ্রের এবং প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদত ছিল লুম্পেনদের পক্ষে। অপরদিকে যারা ছিল তারাও ধোয়া তুলসীর পত্র ছিল না । তবে তাদের নু্যনতম পজেটিভ মনোভাব ছিল, যেমনটা ছিল ছাত্রদলের অস্থানীয় গ্রুপটির । তো যাই হোক, ১৯৯৭ এ লীগের একটি গ্রুপ বামপন্থীদের সাথে সমবেত হয়েই ৩ নং ও ৪ নং ছাত্রী হলের নাম যথাক্রমে প্রীতিলতা এবং জাহানারা ইমাম রাখতে বাধ্য করে প্রশাসন কে । এর পরে ছাত্রলীগের কাউনসিল নিয়ে শুরু হয় সংঘাত । এক পর্যায়ে সভাপতি সমর্থক গ্রুপের একজন নিহত হয় । সাধারণ সম্পাদক সমর্থকেরা প্রথমে নিয়ন্ত্রণ পেলেও কিছুদিন পরে সভাপতি গ্রুপ ফিরে আসে কেন্দ্রের সমর্থনে। এই সভাপতি সমর্থক গ্রুপের বেশীর ভাগই ছিল হার্ড লাইনার। ছাত্রদল থেকে যোগ দেওয়া জসীম উদ্দিন মানিক কিছুদিনের মধ্যেই টপে উঠে যান এবং 1997 এর শেষের দিকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন । মানিক অবশ্য ছাত্রদলে যাওয়ার আগে ছাত্রলীগেও ছিলেন আবার তারও আগে তীতুমীর কলেজে ছাত্রদলও করেছেন । মানে প্রতিভাবান লোক আর কি । তো এই গ্রুপটি প্রথম থেকেই বিনা কারণে একতরফাভাবে বামপন্থীদের উপর চড়াও হয় । জোর করে মিছিলে নামানো , রাতে ঘরে ঢুকে তোষক পেচিয়ে মার-ধোর, ছাত্র নেতার পূণ্য নজরে পড়া কোন মেয়ের সঙ্গে ঘোরা অপরাধে গেস্টরূমে ঠ্যাঙ্গানো পরবতর্ী তওবা করানো এগুলো চলতে থাকে পুরোদমে । আমার মতো জ্ঞানীলোক হওয়ার সুযোগ গ্রাম থেকে আসা পোলাপানের ছিল না যে নেতাদের কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া এবং মাঝে-মধ্যে বস খবরকি ইত্যাদি র মাধ্যমে পিঠ বাচাবে । তো এই অত্যাচার কিছুদিনের মধ্যেই বামের সীমা পার হয়ে নিরীহ পোলাপানের উপর শুরু হইলো ।ব্যাপারটা এমন অসহ্য অবস্থায় গিয়া পৌছাইল যে অনেকেই হলের সীট ছাইড়া ঢাকার বাসায় মানে যারা ঢাকার আরকি, আপ-ডাউন কইরা ক্লাস করা শুরু করলো । হলে থাকলেই কখন কোন বাটে পড়ে সবাই এই আতঙ্কে থাকতো । আমি ধরা খাই নাই চরম সুবিধা বাদী বইলাই । কারণ তখন রাজনীতি না করা বহুৎ পোলাপান খালি মিছিল না করার কারণে ধোলাই খাইছে । আমার রাজনীতি করার কোন ইচ্ছা ছিল না , মানে টিপিক্যাল সুবিধাবাদী ফ্রেমে চিন্তা করলে যেমন হয় আরকি । তাই মাইর এড়াইয়া চলার ক্ষেত্রে বহু ধরনের সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করতে হইতো । মাইর খাইতেছিল মুলত সহজ সরল পোলাপানগুলা । কোন এক ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেকে ডেকে হয়তো নেতাজী বল্লেন , তগো কেলাসের অমুক মেয়েটার লগে আমার আলাপ করাইয়া দে বা রূম নম্বর দে ইত্যাদি । কোন বোকা ছেলে রাজী না হওয়া মাত্রই সোনার ছেলেরা রড নিয়ে চড়াও হতেন । আর বাম নেতা কমর্ীদের পিটানোর ব্যাপারে হলে হলে রুটিন ছিল । আজকে এই হলের এই ব্লক কালকে ঐ ব্লক ইত্যাদি । সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড রীতিমতো থমকে দাড়লো একই সাথে । যে সুন্দর ক্যাম্পাসের স্বপ্ন দেখে ভর্তি হয়েছিলাম তা উবে গেল পুরোপুরি । এর মধ্যে ১৯৯৭ এর ১১ ডিসেম্বর আমিন বাজারের ট্রাক ড্রাইভাররা ক্যাম্পাসের বাস ভাঙ্গায় (এই কাহিনি পরে বলবো ) শুরু হলো ট্রাক-ড্রাইভার বিরোধী আন্দোলন । স্বত্রস্ফুর্তভাবে শুরু হলেও বামনেতারা মিশে গেলেন স্রোতের সঙ্গে । সমস্যা হলো যে চোরাচালানের চান্দা খোর হবার কারনে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে তখন ট্রাক মালিকদের ব্যপক প্রেম । ছাত্রলীগ প্রথমে স্রোতে ভয় পেলেও পরে ডাকা থেকে গ্রীন সিগনাল পেয়ে হুমকী দিতে শুরু করলো এবং ১৭ ডিসেম্বর সরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সামনে পুলিশ পেছনে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের দিলো রাম ধোলাই। এই ঘটনার মাধ্যমেই বলা যায় ছাত্রলীগের রাজনৈতিক আত্মহত্যার যে প্রক্রিয়া চলছিল তার ষোলকলা পূর্ণ হয় । আরন্দালন পুরোপুরি দমন হয়েগেলো নির্যাতনের মাত্রা অনেক অনেক বেড়ে যাওয়ায়। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শিক্ষকদের উপর হামলার বিষয়টি পর্যন্ত। আমার বহু বন্ধু-বান্ধব ভালো রকম আহত হলেন । আমাদের বিভাগীয় প্রধান ড.নাসিম আখতার হোসাইন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাঈদ ফেরদৌস, মানস চৌধুরী এবং আরো অনেক শিক্ষক মার খেয়েছিলেন সেদিন । যাই হোক । ছাত্রলীগ ঐ পরিস্থিতিতে গায়ের জোরে জিতলেও । পোলাপান ভিতরে ভিতরে ফুসতে থাকলো । ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে ঘিয়া মনে হইলো ই প্রেক্ষাপট জানানো খুবই জরুরি । নাইলে খবরের কাগজ পড়া জেনারেলাইজেশানের দিকে চইলা যাইতে পারে ।

No comments: