আরো একটা বীয়ার খুলে মাকসুদ বেশ মুন্সীয়ানার সাথে গ্লাসে ঢালে। বারে কাজ করতে গেলে প্রথমেই যে কয়েকটা জিনিস শিখতে হয় তার মধ্যে ফেনা সামলে গ্লাসে বীয়ার ঢালা একটি। সোহাগ বিড়ি ধরিয়ে ভক্ করে কিছু ধোঁয়া ছাড়ে। রিং বানাবার আরো একটা ব্যর্থ চেষ্টা। ঘড়িতে বাজে রাত সোয়া নয়টা। আরো এক ঢোঁক বীয়ার আর তারসাথে আরো এক খাবলা ধোঁয়া ছেড়ে সোহাগ বললো,
- প্রথম পর্বটা বানাইতে তোর সব মিলাইয়া সময় লাগছে বারো মিনিট সাতাইশ সেকেন্ড।
- এইটা মনে হয় একটা চেইন বিক্রিয়ার মতো হৈবো। একটু পরে দেখবি একেক পর্ব বানাইতে গড়ে পাঁচ-ছয় মিনিটের বেশী লাগবো না। তয় পিনিক গেলেগা কী হৈবো বলা মুস্কিল।
- দ্বিতীয় পর্বটা তাইলে আমি বানাই।
- গো এহেড.....
দ্বিতীয় পর্ব
(প্রথম দৃশ্য)
ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরের অন্দরমহল।
জনৈক কুতুব অবশেষে তার সুটকেস পেয়েছেন। বেল্ট থেকে নামাতে গিয়ে প্রথমেই দুর্ঘটনা। চামড়ার থুড়ি রেক্সিনের সুটকেসের রেক্সিনের হাতলটা পট্ করে ছিঁড়লো। ওটা এমনিতেও তেমন কাজে লাগতো না। বাম দিকের কোনায় অন্য একটা হাতল আছে যেটা দিয়ে সুটকেসকে ট্রলি বানিয়ে টানা যায়। তবু নতুন সুটকেসের অঙ্গহানি বলে কথা। দুর্ঘটনা দিয়ে জার্মান জীবনের শুরু হলো। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে? সুটকেস টানতে টানতে গ্রীন চ্যানেল দিয়ে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই বের হওয়া গেল। চারদিকে সবাই ম্লেচ্ছ। এতক্ষণে একটা কোণঠাসা অনুভুতি পেয়ে বসলো আমাদের "কুতুব"কে। ঠিক কোণঠাসা না, আগন্তুকের অনুভুতি বলা যেতে পারে। পিঠে বোঝা কাঁধে ব্যাগ আর হাতে বিশাল সুটকেসটা ঘড় ঘড় করতে করতে টার্মিনাল-২ এলাকায় গোটা তিনেক চক্কর দেয়। চতুর্থ চক্করের শুরুতে অনেক সাহস সঞ্চয় করে ইনফর্মেশান ডেস্কে গিয়ে নড়বড়ে জার্মানে জিজ্ঞাসা করলো বিমানবন্দর থেকে কাসেলের ডাইরেক্ট ট্রেন কোথা থেকে কীভাবে পাওয়া যেতে পারে। কর্তব্যরত ভদ্রমহিলা মুখে খুব দুর্বোধ্য একটা কিছু বললেও আঙ্গুল দেখালেন উত্তর-পূর্ব কোণে একটা চলমান সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির পাশে "ডয়টশে বান" এর একটা অফিস। সেখানে অনেক ভিড়। দশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে কাসেলগামী আইসিই'র টিকেট কাটা গেলো। মূল্য ৫৫ ইউরো। দেশ থেকে আনা দুশো ইউরোর নোটটা এগিয়ে দিয়ে একশো পয়তাল্লিশ পকেটে ফিরলো। তারপর চলমান সিঁড়ি দিয়ে নানা কায়দায় সুটকেস সামলে মোড়ে মোড়ে গন্তব্য নির্দেশক অনুসরণ করে অবশেষে প্লাটফর্ম। ট্রেন আসতে আর সাত মিনিট বাকি।
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
খেলার মাঠ মানে সেই তথাকথিত ক্রিকেট মাঠ যেটা একদা হকি খেলার টার্ফ ছিল। খেলার আর তিন বল বাকি। তিন বলে বারো। মাসুমদের স্কোর ছিল দশ ওভারে একাশি। স্ট্রাইকে চয়ন ননস্ট্রাইকিং এন্ডে নান্টু। মির্জার পরের বল হাল্কা অফস্পিন করে ভেতরে ঢোকার মুখে হাঁটু গেড়ে স্কোয়ার লেগে গ্রীলের উপর দিয়ে তুলে মারলো চয়ন। সোজা গিয়ে লাগলো কে-নাইন্টিনের দেওয়ালে। আম্পায়ার জসীমের দুইহাতে উপরে। দুই বলে ছয়। পরের বল মাটিতে পড়ার আগে ফুলটস নিয়ে লং অফের দিকে। বীচ ভলিবল কোর্টের কাছাকাছি বাউন্ডারীতে মকবুল খানিক টাকিমাছ ধরার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দুই রান, জোশের ঠেলায় তৃতীয় রান নিতে নিতে বল বোলারের হাতে। চয়ন রান আউট। এক বলে চার রান। আবার ফুলটস। কটঅ্যান্ডবোল্ড মিস করে মির্জার হাত গলে বল সোজা কে-এইট্টিনের দেওয়ালে। মির্জা জিভ কেটে বসে পড়ে।
- হালা এল্লেগাই কই রিফ্লেক্স ঠিক করতে।
- পুরা নেইল বাইটিং গেম। প্রতিদিন এরকম হৈলে খেইলা চাম আছে।
হাল্কা জগিং করতে করতে মকবুল বলে।
- যাউক গা। এখন চল সবাই বানহফে (বানহফ = স্টেশন) যাই আস্তে আস্তে। যাইতেও তো আধাঘন্টার মতো লাগবো।
- তোরা যা আমি ঘরে যাই। গোসল করুম।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মির্জা বললো। জয় আর নান্টুও মুখে ক্লান্তির ভাব দেখিয়ে জানালো তারা যাচ্ছে না। মাসুমও যাবে না। গাবি তাড়া দিচ্ছে। ব্যাটবল জয়কে গছিয়ে দেওয়া হলো। ঘরে এই মুহুর্তে জায়গা নাই অজুহাতে জয় সেটা মাসুমকে গছালো। আসল কথা হলো মাসুম আর গাবির কাবাবে কৃত্রিম হলেও খানিক হাঁড় যোগ করা। বিড় বিড় করে গালি দিতে দিতে মাসুম ব্যাগ কাঁধে নেয়। সবাই গুটিশুঁটি হাটা দেয় হল্যান্ডিশারস্ট্রাসে ট্রামস্টেশনের দিকে।
- পোলা থাকবো কৈ আইসা?
- আমার বাসায়।
সস্তা তামাকে সিগারেট বানাতে বানাতে জানালো জসীম।
- দুপুরে বাইর হওয়ার আগে মুরগীভুনা আর ডাইল রাইন্ধা রাখছি। গিয়া খালি ভাত রানলেই হৈবো। সবাই থাকিস।
- পোলার কপাল ভালো। নাইমাই রান্ধা করা ভাত তরকারি পাইতাছে। আচ্ছা অর নামটা জানি কী? ভুইলা গেছি।
- কুতুবুদ্দিন পাটোয়ারী।
- কছ কী! সিরিয়াস !
- পুরা। হালায় একটা রিয়েল কুতুব। ইনফ্যাক্ট আমার দেখা প্রথম কুতুব।
ক্যামেরা আস্তে আস্তে উপরে উঠবে। মেনজার ছাদে পড়ন্ত রোদের শেষ টুকরো ক্রমশ আরো ফিকে হয়ে আসছে। ক্যামেরা সোজা মার্সিডিজ টাওয়ারের চুড়ায় পৌছে খানিক ডানে সরে গোধুলির আকাশে থামবে।
(তৃতীয় দৃশ্য)
ক্যামেরা সুটকেসের উপরে। বড় একটা ডিমাই কাগজে হাতে লেখা ঠিকানা।
কুতুবুদ্দিন পাটোয়ারী
স্টুডেন্টেনভেয়ার্ক
ভোলফহাগারস্ট্রাসে ১০
৩৪১২৭ কাসেল
জার্মানী।
পুরো দমে এগিয়ে চলছে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। কোনরকমে একটা সীট পেয়ে জানালা দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে কুতুব। তারপর ক্যামরা এগোবে পরের কম্পার্টমেন্টের বারান্দা দিয়ে পরবর্তী সেকেন্ডক্লাস বগীর দিকে। ( যদিও চলন্ত ট্রেনে ক্যামেরার ট্রলি কীভাবে চলে বা আদৌ চলে কী না জানি না। বলে সোহাগ চোখ টিপে। আরে আমরাতো নাটক বানামু নরমাল ডিজিটাল ক্যামেরায়। মাকসুদকে থামিয়ে সোহাগ বললো আরে না। ভাবনার নাও টাইটানিক। বানামু যখন আসল ক্যামেরা দিয়াই বানামু) ক্যামেরা জানালা দিয়ে খানিক বাইরে তাকাবে। দিন শেষের ফিকে আলোয় পাহাড়ের পর পাহাড় মাঠের পর মাঠ। একটা দুটো তিনটে চারটে জানালা পার হয়ে কাঁচের দরজার ওপারে আরো একটা সেকেন্ড ক্লাস বগী। দ্বিতীয় সারির একটা ফোর সিটেডের একধারে জানালার পাশে বসে কী একটা সস্তা জার্মান উপন্যাস পড়ার অভিনয় করছে খাকি গ্যাবার্ডিন আর কালো টিশার্ট পড়া শারমিন।
টিকেট চেকারের আগমন। পকেট থেকে টিকেট বের করে চেকারের হাতে দিতে ভদ্রলোক একটা সীল মেরে দিলেন।
- এন্টশুলডিগুঙ। গিব্ট এস হিয়ার আইন কাফেআউটোমাট ওডার এনলিশেস? ( মাফ করবেন। এখানে কি কফি মেশিন জাতীয় কিছু পাওয়া যাবে?)
- ইয়া। দা হিন্টেন ইম লেটস্টেন কম্পার্টমেন্ট। ( হ্যা। ঐ পেছন দিকে। গাড়ির শেষ কম্পার্টমেন্টে।)
- ফিলেন ডাঙ্ক। ( অনেক ধন্যবাদ)
- গেয়ার্ন গেশেয়েন ( প্লেজার)
কফি মেশিন কোথায় এটা মোটেও শারমিনের অজানা নয়। শুধু আশেপাশের লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষনের উদ্দেশ্যেই এই জার্মান ফুটানো। বইটা ব্যাগে ভরে বগীর সামনে ঘড়ির দিকে তাকায় শারমিন। সাতটা তেরো। আরো আধাঘন্টার মতো পথ। বাইরে রোদ পড়ে আসা সত্ত্বেও সানগ্লাস চোখে পিছনের বগীর দিকে রওনা হয়ে গেলো। চলন্ত ট্রেনে গতির বিপরীতে হাঁতে গেলে শারমিনের বরাবরই একটা কার্টুন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। দেয়াল ধরে ধরে বারান্দা পেরিয়ে পরের কম্পার্টমেন্টে ঢুকতেই সুটকেসে পা আটকে উস্টা খেয়ে ফ্লোরে। কুতুবের কোলে পড়ার দুরবর্তী সম্ভাবনাও সেখানে ছিল না।
কোনরকমে মাটি থেকে উঠে সামনে বাদামী চামড়ার থতমত চেহারা দেখেই ঝাড়ি ,
- যিন্ড যি বেশয়ার্ট? ভারুম হাবেন যি ডেন কফার আইফাখ আউফ'ম ভেগ গেলাসেন? ( পাগল না কী? রাস্তার উপর সুটকেস রাখছেন ক্যান?)
- ইয়ে মানে..আই মিন ...ঈশ মাইনে...সরি !
- হোয়াট সরি?
- সরি ফর এভরিথিং। আই ডোন্ট নো হোয়ার টু পুট ইট। আই ওয়াজ ইন আ হারি।
- ইটস ওকে। বাট ইফ ইউ ডোন্ট নো ইউ ক্যান অলওয়েজ আস্ক সামওয়ান। নাইস ট্রিপ এনিওয়ে।
একরকম মুখ ঝামটা দিয়ে শারমিন পরের বগীর দিকে এগোয়। ঘটনার আকস্মিকতায় কুতুব আরো কিছুক্ষণ থম ধরে থাকে। দেখে তো বেশ বোঝা যাচ্ছে দক্ষিন এশিয়ার কোন দেশ থেকে এসেছে। তাতেই এতো দাপট! সাহেবী উচ্চারণে জার্মান-ইংরেজী ভেজে গেলো। এই ধরনের ইংরেজীকে সৈয়দ মুজতুবা আলী বলেছিলেন গাঁক গাঁক করে ইংরেজী বলা। এরকম জার্মান কে কী বলা যেতে পারে? ঘোঁৎ ঘোঁৎ? হ্যা। কয়েন করা গেলো কথাটা। একটা লিমেরিক হতে পারে :
ঘোঁৎ ঘোঁৎ মাগী তার
ফিগারটা চোস্ত
জ্যামিতির মাপে খাপে
জাগামতো গোস্ত
এতক্ষণে হাসি ফোটে কুতুবের মুখে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দুরে হারকিউলিসের চুড়া দেখা যাচ্ছে। কাসেল পৌঁছতে আর মিনিট চারেক।
(চলবে)
- প্রথম পর্বটা বানাইতে তোর সব মিলাইয়া সময় লাগছে বারো মিনিট সাতাইশ সেকেন্ড।
- এইটা মনে হয় একটা চেইন বিক্রিয়ার মতো হৈবো। একটু পরে দেখবি একেক পর্ব বানাইতে গড়ে পাঁচ-ছয় মিনিটের বেশী লাগবো না। তয় পিনিক গেলেগা কী হৈবো বলা মুস্কিল।
- দ্বিতীয় পর্বটা তাইলে আমি বানাই।
- গো এহেড.....
দ্বিতীয় পর্ব
(প্রথম দৃশ্য)
ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরের অন্দরমহল।
জনৈক কুতুব অবশেষে তার সুটকেস পেয়েছেন। বেল্ট থেকে নামাতে গিয়ে প্রথমেই দুর্ঘটনা। চামড়ার থুড়ি রেক্সিনের সুটকেসের রেক্সিনের হাতলটা পট্ করে ছিঁড়লো। ওটা এমনিতেও তেমন কাজে লাগতো না। বাম দিকের কোনায় অন্য একটা হাতল আছে যেটা দিয়ে সুটকেসকে ট্রলি বানিয়ে টানা যায়। তবু নতুন সুটকেসের অঙ্গহানি বলে কথা। দুর্ঘটনা দিয়ে জার্মান জীবনের শুরু হলো। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে? সুটকেস টানতে টানতে গ্রীন চ্যানেল দিয়ে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই বের হওয়া গেল। চারদিকে সবাই ম্লেচ্ছ। এতক্ষণে একটা কোণঠাসা অনুভুতি পেয়ে বসলো আমাদের "কুতুব"কে। ঠিক কোণঠাসা না, আগন্তুকের অনুভুতি বলা যেতে পারে। পিঠে বোঝা কাঁধে ব্যাগ আর হাতে বিশাল সুটকেসটা ঘড় ঘড় করতে করতে টার্মিনাল-২ এলাকায় গোটা তিনেক চক্কর দেয়। চতুর্থ চক্করের শুরুতে অনেক সাহস সঞ্চয় করে ইনফর্মেশান ডেস্কে গিয়ে নড়বড়ে জার্মানে জিজ্ঞাসা করলো বিমানবন্দর থেকে কাসেলের ডাইরেক্ট ট্রেন কোথা থেকে কীভাবে পাওয়া যেতে পারে। কর্তব্যরত ভদ্রমহিলা মুখে খুব দুর্বোধ্য একটা কিছু বললেও আঙ্গুল দেখালেন উত্তর-পূর্ব কোণে একটা চলমান সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির পাশে "ডয়টশে বান" এর একটা অফিস। সেখানে অনেক ভিড়। দশ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে কাসেলগামী আইসিই'র টিকেট কাটা গেলো। মূল্য ৫৫ ইউরো। দেশ থেকে আনা দুশো ইউরোর নোটটা এগিয়ে দিয়ে একশো পয়তাল্লিশ পকেটে ফিরলো। তারপর চলমান সিঁড়ি দিয়ে নানা কায়দায় সুটকেস সামলে মোড়ে মোড়ে গন্তব্য নির্দেশক অনুসরণ করে অবশেষে প্লাটফর্ম। ট্রেন আসতে আর সাত মিনিট বাকি।
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
খেলার মাঠ মানে সেই তথাকথিত ক্রিকেট মাঠ যেটা একদা হকি খেলার টার্ফ ছিল। খেলার আর তিন বল বাকি। তিন বলে বারো। মাসুমদের স্কোর ছিল দশ ওভারে একাশি। স্ট্রাইকে চয়ন ননস্ট্রাইকিং এন্ডে নান্টু। মির্জার পরের বল হাল্কা অফস্পিন করে ভেতরে ঢোকার মুখে হাঁটু গেড়ে স্কোয়ার লেগে গ্রীলের উপর দিয়ে তুলে মারলো চয়ন। সোজা গিয়ে লাগলো কে-নাইন্টিনের দেওয়ালে। আম্পায়ার জসীমের দুইহাতে উপরে। দুই বলে ছয়। পরের বল মাটিতে পড়ার আগে ফুলটস নিয়ে লং অফের দিকে। বীচ ভলিবল কোর্টের কাছাকাছি বাউন্ডারীতে মকবুল খানিক টাকিমাছ ধরার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দুই রান, জোশের ঠেলায় তৃতীয় রান নিতে নিতে বল বোলারের হাতে। চয়ন রান আউট। এক বলে চার রান। আবার ফুলটস। কটঅ্যান্ডবোল্ড মিস করে মির্জার হাত গলে বল সোজা কে-এইট্টিনের দেওয়ালে। মির্জা জিভ কেটে বসে পড়ে।
- হালা এল্লেগাই কই রিফ্লেক্স ঠিক করতে।
- পুরা নেইল বাইটিং গেম। প্রতিদিন এরকম হৈলে খেইলা চাম আছে।
হাল্কা জগিং করতে করতে মকবুল বলে।
- যাউক গা। এখন চল সবাই বানহফে (বানহফ = স্টেশন) যাই আস্তে আস্তে। যাইতেও তো আধাঘন্টার মতো লাগবো।
- তোরা যা আমি ঘরে যাই। গোসল করুম।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মির্জা বললো। জয় আর নান্টুও মুখে ক্লান্তির ভাব দেখিয়ে জানালো তারা যাচ্ছে না। মাসুমও যাবে না। গাবি তাড়া দিচ্ছে। ব্যাটবল জয়কে গছিয়ে দেওয়া হলো। ঘরে এই মুহুর্তে জায়গা নাই অজুহাতে জয় সেটা মাসুমকে গছালো। আসল কথা হলো মাসুম আর গাবির কাবাবে কৃত্রিম হলেও খানিক হাঁড় যোগ করা। বিড় বিড় করে গালি দিতে দিতে মাসুম ব্যাগ কাঁধে নেয়। সবাই গুটিশুঁটি হাটা দেয় হল্যান্ডিশারস্ট্রাসে ট্রামস্টেশনের দিকে।
- পোলা থাকবো কৈ আইসা?
- আমার বাসায়।
সস্তা তামাকে সিগারেট বানাতে বানাতে জানালো জসীম।
- দুপুরে বাইর হওয়ার আগে মুরগীভুনা আর ডাইল রাইন্ধা রাখছি। গিয়া খালি ভাত রানলেই হৈবো। সবাই থাকিস।
- পোলার কপাল ভালো। নাইমাই রান্ধা করা ভাত তরকারি পাইতাছে। আচ্ছা অর নামটা জানি কী? ভুইলা গেছি।
- কুতুবুদ্দিন পাটোয়ারী।
- কছ কী! সিরিয়াস !
- পুরা। হালায় একটা রিয়েল কুতুব। ইনফ্যাক্ট আমার দেখা প্রথম কুতুব।
ক্যামেরা আস্তে আস্তে উপরে উঠবে। মেনজার ছাদে পড়ন্ত রোদের শেষ টুকরো ক্রমশ আরো ফিকে হয়ে আসছে। ক্যামেরা সোজা মার্সিডিজ টাওয়ারের চুড়ায় পৌছে খানিক ডানে সরে গোধুলির আকাশে থামবে।
(তৃতীয় দৃশ্য)
ক্যামেরা সুটকেসের উপরে। বড় একটা ডিমাই কাগজে হাতে লেখা ঠিকানা।
কুতুবুদ্দিন পাটোয়ারী
স্টুডেন্টেনভেয়ার্ক
ভোলফহাগারস্ট্রাসে ১০
৩৪১২৭ কাসেল
জার্মানী।
পুরো দমে এগিয়ে চলছে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। কোনরকমে একটা সীট পেয়ে জানালা দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে কুতুব। তারপর ক্যামরা এগোবে পরের কম্পার্টমেন্টের বারান্দা দিয়ে পরবর্তী সেকেন্ডক্লাস বগীর দিকে। ( যদিও চলন্ত ট্রেনে ক্যামেরার ট্রলি কীভাবে চলে বা আদৌ চলে কী না জানি না। বলে সোহাগ চোখ টিপে। আরে আমরাতো নাটক বানামু নরমাল ডিজিটাল ক্যামেরায়। মাকসুদকে থামিয়ে সোহাগ বললো আরে না। ভাবনার নাও টাইটানিক। বানামু যখন আসল ক্যামেরা দিয়াই বানামু) ক্যামেরা জানালা দিয়ে খানিক বাইরে তাকাবে। দিন শেষের ফিকে আলোয় পাহাড়ের পর পাহাড় মাঠের পর মাঠ। একটা দুটো তিনটে চারটে জানালা পার হয়ে কাঁচের দরজার ওপারে আরো একটা সেকেন্ড ক্লাস বগী। দ্বিতীয় সারির একটা ফোর সিটেডের একধারে জানালার পাশে বসে কী একটা সস্তা জার্মান উপন্যাস পড়ার অভিনয় করছে খাকি গ্যাবার্ডিন আর কালো টিশার্ট পড়া শারমিন।
টিকেট চেকারের আগমন। পকেট থেকে টিকেট বের করে চেকারের হাতে দিতে ভদ্রলোক একটা সীল মেরে দিলেন।
- এন্টশুলডিগুঙ। গিব্ট এস হিয়ার আইন কাফেআউটোমাট ওডার এনলিশেস? ( মাফ করবেন। এখানে কি কফি মেশিন জাতীয় কিছু পাওয়া যাবে?)
- ইয়া। দা হিন্টেন ইম লেটস্টেন কম্পার্টমেন্ট। ( হ্যা। ঐ পেছন দিকে। গাড়ির শেষ কম্পার্টমেন্টে।)
- ফিলেন ডাঙ্ক। ( অনেক ধন্যবাদ)
- গেয়ার্ন গেশেয়েন ( প্লেজার)
কফি মেশিন কোথায় এটা মোটেও শারমিনের অজানা নয়। শুধু আশেপাশের লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষনের উদ্দেশ্যেই এই জার্মান ফুটানো। বইটা ব্যাগে ভরে বগীর সামনে ঘড়ির দিকে তাকায় শারমিন। সাতটা তেরো। আরো আধাঘন্টার মতো পথ। বাইরে রোদ পড়ে আসা সত্ত্বেও সানগ্লাস চোখে পিছনের বগীর দিকে রওনা হয়ে গেলো। চলন্ত ট্রেনে গতির বিপরীতে হাঁতে গেলে শারমিনের বরাবরই একটা কার্টুন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। দেয়াল ধরে ধরে বারান্দা পেরিয়ে পরের কম্পার্টমেন্টে ঢুকতেই সুটকেসে পা আটকে উস্টা খেয়ে ফ্লোরে। কুতুবের কোলে পড়ার দুরবর্তী সম্ভাবনাও সেখানে ছিল না।
কোনরকমে মাটি থেকে উঠে সামনে বাদামী চামড়ার থতমত চেহারা দেখেই ঝাড়ি ,
- যিন্ড যি বেশয়ার্ট? ভারুম হাবেন যি ডেন কফার আইফাখ আউফ'ম ভেগ গেলাসেন? ( পাগল না কী? রাস্তার উপর সুটকেস রাখছেন ক্যান?)
- ইয়ে মানে..আই মিন ...ঈশ মাইনে...সরি !
- হোয়াট সরি?
- সরি ফর এভরিথিং। আই ডোন্ট নো হোয়ার টু পুট ইট। আই ওয়াজ ইন আ হারি।
- ইটস ওকে। বাট ইফ ইউ ডোন্ট নো ইউ ক্যান অলওয়েজ আস্ক সামওয়ান। নাইস ট্রিপ এনিওয়ে।
একরকম মুখ ঝামটা দিয়ে শারমিন পরের বগীর দিকে এগোয়। ঘটনার আকস্মিকতায় কুতুব আরো কিছুক্ষণ থম ধরে থাকে। দেখে তো বেশ বোঝা যাচ্ছে দক্ষিন এশিয়ার কোন দেশ থেকে এসেছে। তাতেই এতো দাপট! সাহেবী উচ্চারণে জার্মান-ইংরেজী ভেজে গেলো। এই ধরনের ইংরেজীকে সৈয়দ মুজতুবা আলী বলেছিলেন গাঁক গাঁক করে ইংরেজী বলা। এরকম জার্মান কে কী বলা যেতে পারে? ঘোঁৎ ঘোঁৎ? হ্যা। কয়েন করা গেলো কথাটা। একটা লিমেরিক হতে পারে :
ঘোঁৎ ঘোঁৎ মাগী তার
ফিগারটা চোস্ত
জ্যামিতির মাপে খাপে
জাগামতো গোস্ত
এতক্ষণে হাসি ফোটে কুতুবের মুখে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দুরে হারকিউলিসের চুড়া দেখা যাচ্ছে। কাসেল পৌঁছতে আর মিনিট চারেক।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment