হার্ডব্রেকে চোখ খুলে দেখি একটা কাটা পাহাড়ের নিচে বাস থেমে আছে। কাঠবডি বাস থেকে লোক নামাও একটা ঝক্কি। সব একসাথে নামতে চায়। যাই হোক। কোন একসময় নামতে পারলাম। তারপর কোথায় যাবো? আমি আর সেলিমভাই অতীতে কখনো এই মুল্লুকে আসি নাই। জয় যেদিক নিয়ে যাবে সেদিকই যেতে হবে। একটা রিক্সা নিয়ে কিছুদুর যাওয়ার পরে ছেড়ে দেওয়া হলে আমাদের সন্দেহ হলো। জয়কে ধরা হলো, আসলেই সে মুমুদের বাসা চেনে কিনা। জয় নানাভাবে আঁকিয়েবাঁকিয়ে বোঝালো বাসাটা সে চেনে কিন্তু ঠিক কোথায় ঠাহর করতে পারছে না। আমাদের অধিক শোকে পাথর মারা ঠেকিয়ে পরের মোড়েই মুমুদের বাসা আবিস্কৃত হলো।
বান্দরবান শহরটা আসলে ছোট একটা মহল্লা বলা যেতে পারে। একচক্কর ঘুরে আসতে অনুর্ধ্ব ঘন্টা খানেক লাগে। নাম ধরে বাসা পাওয়া যায়। সে যাই হোক। মুমুদের বাসার দরজায় আমাকে আর সেলিমভাইকে দাঁড় করিয়ে জয় চলে গেল অন্দরমহলে। আমরা পরামর্শ করছিলাম জয় মিয়া নেতিবাচক জবাবে ফিরে এলে কোনদিক যাওয়া যায় ইত্যাদি। প্রায় আধাঘন্টা পরে জয় ফিরে এলো। মুমু এখনো অবিবাহিত। রাজপুত্র নাকি অসুস্থ। সুস্থ হলে আগামী শীতে বা বসন্তে চারহাত এক হতে পারে। তবে এ বাড়িতে আমরা আপাতত সাদরামন্ত্রিত।
লাজুক মুখে ভেতরে গেলাম। মুমুর ভাইয়ের ঘরে ঠাঁই হলো। ওর ভাই মংশাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র। এখন হলে আছে বিধায় তার ঘর খালি। মালপত্র রেখে একটু গা মোচড় দিতেই মধ্যাহ্ন ভোজনের ডাক। বিনা আমন্ত্রণের অতিথি হিসেবে সেদিন দুপুরে জুটলো মূলত বাঁশ। মানে কচি বাঁশের চচ্চরি। সাথে অতি অল্প হলুদে রাঁধা ডাল আর নিরিহ ভাত। পেটে ক্ষুধা ছিল। পাতে যাই থাক অনুর্ধ্ব দশ মিনিটে নি:শেষ। পরের কয়েকদিনে অবশ্য এই মসলাদরিদ্র খাবারগুলির ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রার পরে মুমু এসে বললো তোমরা ইচ্ছা করলে ঘুরে আসতে পারো শহরে আমার একটু বের হত হবে জরুরি ইত্যাদি। সেই সাথে রাজপুত্রকে ফোন করা হলো যাতে রাজবাড়িতেও আমরা অভ্যাগত হই ইত্যাদি।
বের হলাম। প্রথমে বাসায় ফোন করে জানালাম সব ঠিকাছে। সেই ফোনফ্যাক্সের দোকান থেকে দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের রেখা। সেই রেখা বরাবর হাঁটতে থাকলাম। একটা ছোট বাজার মতো পড়লো পথে। তারপর রাজবাড়ি। সেখানে তালা। জানলাম ওটা পুরনো রাজবাড়ি। বর্তমান রাজবাড়ি তার থেকে খানিক ডানে। গেলাম। পরিচয় দেওয়া হলো। রাজপুত্র অভ্যর্থনা জানালেন।
নতুন রাজবাড়ি আর রাজপুত্র দুটোই আমাদের কিঞ্চিৎ হতাশ করলো। হতাশার কারণ রাজা আর রাজবাড়ি বিষয়ক প্রচলিত ছায়াচিত্র। রাজপুত্র অতিশয় ভদ্রলোক। উত্তম আপ্যায়ন করলেন। আমাদের চিম্বুকের দিকে যাবার প্ল্যান আছে শুনে বললেন চিম্বুকের চুড়ায় একটা বাংলো আছে সেখানে তাঁর কথা বললে ঠাঁই হতে পারে ইত্যাদি। ।ভদ্রলোক একটা মজার তথ্য দিলেন। এই পর্যন্ত নাকি পাহাড়ে যতবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সবই আর্মির গাড়ি। চান্দের গাড়ি কখনো ঢালে পড়েনি! মোটামুটি পেটপুরে খাওয়াদাওয়া করে বের হলাম রাত নটার দিকে। রাজপুত্র অসুস্থ। গুরুপাক খাওয়া নিশেধ। সুতরাং আমাদেরো নিরিহ কিছুই খেতে হলো।
ফেরার পথে আমি আর সেলিম ভাই জয়কে পাকড়াও করলাম। দুটো জরুরি প্রশ্ন:
১. মাল পেতে আর কতো বাকি?
২. মুমুর সাথে তার পরিচয় কিভাবে?
প্রথম প্রশ্নের জবাবে জয়কেও দু:শ্চিন্তিত দেখা গেলো। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে ছোকরা স্মৃতিকাতর হলো। গত বিজুতে সাঙ্গু নদীতে বেড়াতে এসে কোন এক আন্ধা ফাঁদে ফসকে ডুবে মরতে বসেছিলো। সেই পরিস্থিতিতে মংশাই তাকে বাঁচায়। তারপর মুমূর্ষু ছোঁড়াকে বাড়িতে নিয়ে সেবাটেবা করে সুস্থ করার ফেইজে, মংশাইয়ের বোনের সাথে খাতির এবং আসন্ন বিবাহের নিমন্ত্রণ ইত্যাদি। আমরা আপাতত বিশ্বাস করলাম।
মুমুদের বাসায় ফিরে দেখি মংশাই বাড়ি ফিরেছে। আগামীকাল থেকে ৪৮ ঘন্টা হরতাল। সেইসূত্রে ভদ্রলোক দুদিনের জন্য বাড়ি ফিরেছেন। এটা হচ্ছে সেই হরতাল যেবার সাদেক হোসেন খোকার রক্তাক্ত ছবি পত্রিকার সামনের পাতায় এসেছিল এবং সাকাচৌ সেই বোম্বাস্টিং মন্তব্য করেছিলেন। সে যাই হোক। ছেলেটাকে খুব ভালো লাগলো। সেদিন আরেকদফা ভুড়িভোজ আর গালগপ্পে কেটে গেলো।
পরদিন সকালে চিম্বুক যাত্রা। বান্দরবান শহরে হরতাল। বহুকৌশলে একটা বেবিটেক্সি পাওয়া গেলো, তবে সে চিম্বুক যেতে রাজী নয় কোনভাবেই, মেরেকেটে বারোমাইল নামক কোন এক খাঁজ পর্যন্ত যেতে রাজী মোটা ভাড়ার বিনিময়ে। মংশাইয়ের পরিচিত আঞ্চলিক বি.এন.পি. নেতা বললেন পাহাড়ী রাস্তায় পিকেটিং এর কোন ঝামেলা নেই কিন্তু বেবিওয়ালা সেটা মানতে নারাজ। সেক্ষেত্রে কিছু কৃত্রিম পরিচয় ধারণ করা গেলো। জয় সোম্বাদিক, সেলিমভাই ফটোগ্রাফার, আমি "লেখক" :D।
সকাল আটটায় রওনা করেছিলাম। সাড়ে নয়টা নাগাদ থেমে গেলো। বলে তেল নেই ইত্যাদি। পাওনা মিটিয়ে খাড়াই পথে এগোলাম ত্রিমুর্তি। মিনিট পনের খাড়াই পথে এগোতে একটা বাজার মতো পাওয়া গেলো। সেখানে চাচু খাওয়া গেলো। দোকান্দারের চেহারা থেকে তাঁর জাতিগত পরিচয় অস্পষ্ট থাকায় আমরা একটু ফুসুরফাসুর করাতে তিনি আংরেজীতে বল্লেন, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া অ্যাবাউট ট্রাইবস অ্যান্ড বাঙ্গালীস্ ...রীতিমতো এক্টা কস্ কি কমেন্ট! আমাদেরকে অন্তত টাস্কি খাবার অভিনয় করতে হলো। সেই দোকান থেকে আরো কয়েক প্যাকেট চিপস কিনে বিলটিল মিটিয়ে বের হবার মুখে এক মুরং পিচ্চির সাথে পরিচয়। আমাদের চিম্বুকের পথে এগিয়ে নিয়ে গেলো। প্রায় আধাঘন্টা যাবার পরে বলে আমাদের গ্রাম এই ঢাল বেয়ে নিচে। ঢাল বেয়ে নামলাম। প্রায় মাইল তিনেক। জয়ের উপর দৃশ্যত: রাগ হলেও আদতে তেমন খারাপ লাগছিল না। খানিক পাথুরে ঢাল খানিক জঙ্গল। পিচ্চি তিড়িং বিড়িং করে নামলেও আমাদের ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। মোটামুটি বিধ্বস্ত অবস্থায় মিনিট তিরিশেক পরে পৌঁছলাম সেখানে।
মোটামুটি গভীর অরণ্যে কয়েক ঘর মুরং পরিবার। কথাবার্তা ইশারায় চলে আমাদের সাথে। আমাদের পথপ্রদর্শক পিচ্চিটা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। গিয়ে বসলাম মাচার মতো একটা ঘরে। ঢোকার পথে একটা কুকুর শুয়েছিল। আমাদের দেখে অন্য কাৎ হলো। চেঁচামেচি আশঙ্কা করেছিলাম, কিন্তু দেখা গেলো তার তেমন আগ্রহ নেই। মধ্যাহ্ন ভোজ চলছিল। আমরা আমন্ত্রিত হলাম। আমার খিদে ছিল না, তবে মনে হলো না খেলে গৃহস্থ অসন্তুষ্ট হতে পারেন। দুটো বড় বড় মাটির থালায় বরবটি সিদ্ধ এলো। সাথে একবাটি অপরিশোধিত মোটা লবণ। সেলিমভাই পিঠ থেকে বোর্ড নামিয়ে ধুমধাম কিছু স্কেচ করে ফেললেন। গৃহকর্তা জানালেন এখানে এমনিতে বাইরের লোক তেমন আসেন না। মাঝে মাঝে কিছু বিদেশী লোকজন এসে জামাকাপড়সাবান ইত্যাদি দিয়ে যান। বেড়ার উপর দেখলাম কোন একটা বিদেশী এন.জি,ও.র পোস্টার। ছবি তোলার ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি করে পরে রাজী হলেন। (ছবি পরে অনেকগুলাই নষ্ট হইছিল। কিছু আছে। তবে স্ক্যান করা নাই )।
ঘন্টাখানেক পরে সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবার ফিরতি পথ। এবার উঠতে হবে খাড়াই বেয়ে। হাঁটু আর কোমড় খুলে যাচ্ছিল পিচ্চিকে ফলো করতে গিয়ে। পরে তাকে বলা হলো তুমি বাড়ি যাও। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাকি রাস্তা আমরা যেতে পারবো। পিচ্চি বলল উপরে তার নাকি কি কাজ আছে। আমি জানতে চাইলাম দিনে কতবার আনুমানিক ওঠানামা করো? বলে এই সাতআটবার! যাই হোক, একটু পর পর বিরতি নিয়ে জয়কে গালি দিতে দিতে একসময় পৌঁছলাম সদর রাস্তায়। খাড়াই বাইতে শুরু করার পরে যতটা ক্লান্ত লাগছিল, শেষের দিকে সেটা একেবারেই ছিল না। শুনেছি বেশী উচ্চতায় কারো কারো শ্বাসকষ্ট হয়, কিন্তু আমি বিগত ঘন্টা তিন শ্রমের পরে অতিরিক্ত সুস্থবোধ করছিলাম। পিচ্চি আঙ্গুল দিয়ে দেখালো কোন রাস্তা ধরে যেতে হবে। এবার উপরে তাকিয়ে দেখলাম, আসল খেইল এখন শুরু। এবার আর পাথুরে নয় পিচঢালা খাড়াই বেয়ে উঠতে হবে। চিম্বুক পাহাড়ের চুড়ায় পৌঁছতে আরো বাইশ কিলোমিটার।
শুরু হলো হেলে দুলে হাঁটা। পাহাড় কাটা রাস্তা কখনো বেশী খাড়াই কখনো হঠাৎ ঢালু। প্যাচানো পথের কখনো ডানে কখনো বাঁয়ে আদিগন্ত পাহাড়; পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল আর তার উপর ভাসমান মেঘের ছায়া। আমার জীবনে প্রথম পাহাড়ে এসে পাহাড় দেখা। বিস্ময় একটু বেশীই ছিল হয়তো। তবে মেঘের দৌড় এরপরেও যতবার দেখেছি রোমাঞ্চিত না হয়ে পারিনি। সেদিন সকালে খানিক বৃষ্টি হলেও বাকি সারাদিন খটখটে রোদ। একটু পর পর তৃষ্ণায় জিভ বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই জলের জোগান শেষ। মাঝে বার দুয়েক পাহাড়িগুল্মরাজিকে খানিক ইউরিয়া দান করা গেলো। সভ্য শহর থেকে ততক্ষণে আমরা বহুদূরে। সেখানে হরতালটরতাল নেই। হরতাল কাকে বলে বোঝার লোকও নেই। শুধু শহর থেকে চান্দের গাড়ি আসা বন্ধ। কিন্তু মালবাহী ট্রাক দেখা যাচ্ছিল খানিক পর পর। বার দুয়েক নজরে পড়লো সেনাবাহিনির গাড়ি। প্রায় প্রতিটাই পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলছে। রাজপুত্রের কথা মনে পড়লো। সম্ভবত অতিসতর্কতাই এইসব সুদৃশ্য জিপের ক্বচিৎ পতনের কারণ।
আরো খানিক এগিয়ে তৃষ্ণায় রীতিমতো পেয়ে বসলো। এবার জয়কে নতুন করে গালি দেওয়া শুরু হলো। একটা বোতলটোতল সাথে থাকলে সেরম ফুয়েল পাওয়া যেতো। কিছুদুর গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে আমি ব্যাগ খুলে দেখি আমার ব্যাগে একখানা প্লাস্টিকের বোতল। তবে পানির। তিনজনের ভাগেজোকে শেষ পর্যন্ত তৃষ্ণাই বাড়লো।
ঘন্টা তিনপরে দেখা যায় দৃশ্যত খানিক দূরে চিম্বুকের চুড়ার সেই গেস্ট হাউসের আবছা আভাস । সেইসাথে শুরু হলো ঠান্ডা বাতাস। বাতাসের তোড়ে হাঁটার গতি বাড়ে। মনে হচ্ছিল এই পাহাড়েই চিরকাল থেকে যাই। সভ্যতাটভ্যতার আর দরকার নাই। নেংটি পড়ে হরিণ মেরে মালটেনে বাকি জীবনটা কেটে যাবে।
(চলবে)
বান্দরবান শহরটা আসলে ছোট একটা মহল্লা বলা যেতে পারে। একচক্কর ঘুরে আসতে অনুর্ধ্ব ঘন্টা খানেক লাগে। নাম ধরে বাসা পাওয়া যায়। সে যাই হোক। মুমুদের বাসার দরজায় আমাকে আর সেলিমভাইকে দাঁড় করিয়ে জয় চলে গেল অন্দরমহলে। আমরা পরামর্শ করছিলাম জয় মিয়া নেতিবাচক জবাবে ফিরে এলে কোনদিক যাওয়া যায় ইত্যাদি। প্রায় আধাঘন্টা পরে জয় ফিরে এলো। মুমু এখনো অবিবাহিত। রাজপুত্র নাকি অসুস্থ। সুস্থ হলে আগামী শীতে বা বসন্তে চারহাত এক হতে পারে। তবে এ বাড়িতে আমরা আপাতত সাদরামন্ত্রিত।
লাজুক মুখে ভেতরে গেলাম। মুমুর ভাইয়ের ঘরে ঠাঁই হলো। ওর ভাই মংশাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র। এখন হলে আছে বিধায় তার ঘর খালি। মালপত্র রেখে একটু গা মোচড় দিতেই মধ্যাহ্ন ভোজনের ডাক। বিনা আমন্ত্রণের অতিথি হিসেবে সেদিন দুপুরে জুটলো মূলত বাঁশ। মানে কচি বাঁশের চচ্চরি। সাথে অতি অল্প হলুদে রাঁধা ডাল আর নিরিহ ভাত। পেটে ক্ষুধা ছিল। পাতে যাই থাক অনুর্ধ্ব দশ মিনিটে নি:শেষ। পরের কয়েকদিনে অবশ্য এই মসলাদরিদ্র খাবারগুলির ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রার পরে মুমু এসে বললো তোমরা ইচ্ছা করলে ঘুরে আসতে পারো শহরে আমার একটু বের হত হবে জরুরি ইত্যাদি। সেই সাথে রাজপুত্রকে ফোন করা হলো যাতে রাজবাড়িতেও আমরা অভ্যাগত হই ইত্যাদি।
বের হলাম। প্রথমে বাসায় ফোন করে জানালাম সব ঠিকাছে। সেই ফোনফ্যাক্সের দোকান থেকে দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের রেখা। সেই রেখা বরাবর হাঁটতে থাকলাম। একটা ছোট বাজার মতো পড়লো পথে। তারপর রাজবাড়ি। সেখানে তালা। জানলাম ওটা পুরনো রাজবাড়ি। বর্তমান রাজবাড়ি তার থেকে খানিক ডানে। গেলাম। পরিচয় দেওয়া হলো। রাজপুত্র অভ্যর্থনা জানালেন।
নতুন রাজবাড়ি আর রাজপুত্র দুটোই আমাদের কিঞ্চিৎ হতাশ করলো। হতাশার কারণ রাজা আর রাজবাড়ি বিষয়ক প্রচলিত ছায়াচিত্র। রাজপুত্র অতিশয় ভদ্রলোক। উত্তম আপ্যায়ন করলেন। আমাদের চিম্বুকের দিকে যাবার প্ল্যান আছে শুনে বললেন চিম্বুকের চুড়ায় একটা বাংলো আছে সেখানে তাঁর কথা বললে ঠাঁই হতে পারে ইত্যাদি। ।ভদ্রলোক একটা মজার তথ্য দিলেন। এই পর্যন্ত নাকি পাহাড়ে যতবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সবই আর্মির গাড়ি। চান্দের গাড়ি কখনো ঢালে পড়েনি! মোটামুটি পেটপুরে খাওয়াদাওয়া করে বের হলাম রাত নটার দিকে। রাজপুত্র অসুস্থ। গুরুপাক খাওয়া নিশেধ। সুতরাং আমাদেরো নিরিহ কিছুই খেতে হলো।
ফেরার পথে আমি আর সেলিম ভাই জয়কে পাকড়াও করলাম। দুটো জরুরি প্রশ্ন:
১. মাল পেতে আর কতো বাকি?
২. মুমুর সাথে তার পরিচয় কিভাবে?
প্রথম প্রশ্নের জবাবে জয়কেও দু:শ্চিন্তিত দেখা গেলো। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে ছোকরা স্মৃতিকাতর হলো। গত বিজুতে সাঙ্গু নদীতে বেড়াতে এসে কোন এক আন্ধা ফাঁদে ফসকে ডুবে মরতে বসেছিলো। সেই পরিস্থিতিতে মংশাই তাকে বাঁচায়। তারপর মুমূর্ষু ছোঁড়াকে বাড়িতে নিয়ে সেবাটেবা করে সুস্থ করার ফেইজে, মংশাইয়ের বোনের সাথে খাতির এবং আসন্ন বিবাহের নিমন্ত্রণ ইত্যাদি। আমরা আপাতত বিশ্বাস করলাম।
মুমুদের বাসায় ফিরে দেখি মংশাই বাড়ি ফিরেছে। আগামীকাল থেকে ৪৮ ঘন্টা হরতাল। সেইসূত্রে ভদ্রলোক দুদিনের জন্য বাড়ি ফিরেছেন। এটা হচ্ছে সেই হরতাল যেবার সাদেক হোসেন খোকার রক্তাক্ত ছবি পত্রিকার সামনের পাতায় এসেছিল এবং সাকাচৌ সেই বোম্বাস্টিং মন্তব্য করেছিলেন। সে যাই হোক। ছেলেটাকে খুব ভালো লাগলো। সেদিন আরেকদফা ভুড়িভোজ আর গালগপ্পে কেটে গেলো।
পরদিন সকালে চিম্বুক যাত্রা। বান্দরবান শহরে হরতাল। বহুকৌশলে একটা বেবিটেক্সি পাওয়া গেলো, তবে সে চিম্বুক যেতে রাজী নয় কোনভাবেই, মেরেকেটে বারোমাইল নামক কোন এক খাঁজ পর্যন্ত যেতে রাজী মোটা ভাড়ার বিনিময়ে। মংশাইয়ের পরিচিত আঞ্চলিক বি.এন.পি. নেতা বললেন পাহাড়ী রাস্তায় পিকেটিং এর কোন ঝামেলা নেই কিন্তু বেবিওয়ালা সেটা মানতে নারাজ। সেক্ষেত্রে কিছু কৃত্রিম পরিচয় ধারণ করা গেলো। জয় সোম্বাদিক, সেলিমভাই ফটোগ্রাফার, আমি "লেখক" :D।
সকাল আটটায় রওনা করেছিলাম। সাড়ে নয়টা নাগাদ থেমে গেলো। বলে তেল নেই ইত্যাদি। পাওনা মিটিয়ে খাড়াই পথে এগোলাম ত্রিমুর্তি। মিনিট পনের খাড়াই পথে এগোতে একটা বাজার মতো পাওয়া গেলো। সেখানে চাচু খাওয়া গেলো। দোকান্দারের চেহারা থেকে তাঁর জাতিগত পরিচয় অস্পষ্ট থাকায় আমরা একটু ফুসুরফাসুর করাতে তিনি আংরেজীতে বল্লেন, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া অ্যাবাউট ট্রাইবস অ্যান্ড বাঙ্গালীস্ ...রীতিমতো এক্টা কস্ কি কমেন্ট! আমাদেরকে অন্তত টাস্কি খাবার অভিনয় করতে হলো। সেই দোকান থেকে আরো কয়েক প্যাকেট চিপস কিনে বিলটিল মিটিয়ে বের হবার মুখে এক মুরং পিচ্চির সাথে পরিচয়। আমাদের চিম্বুকের পথে এগিয়ে নিয়ে গেলো। প্রায় আধাঘন্টা যাবার পরে বলে আমাদের গ্রাম এই ঢাল বেয়ে নিচে। ঢাল বেয়ে নামলাম। প্রায় মাইল তিনেক। জয়ের উপর দৃশ্যত: রাগ হলেও আদতে তেমন খারাপ লাগছিল না। খানিক পাথুরে ঢাল খানিক জঙ্গল। পিচ্চি তিড়িং বিড়িং করে নামলেও আমাদের ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। মোটামুটি বিধ্বস্ত অবস্থায় মিনিট তিরিশেক পরে পৌঁছলাম সেখানে।
মোটামুটি গভীর অরণ্যে কয়েক ঘর মুরং পরিবার। কথাবার্তা ইশারায় চলে আমাদের সাথে। আমাদের পথপ্রদর্শক পিচ্চিটা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। গিয়ে বসলাম মাচার মতো একটা ঘরে। ঢোকার পথে একটা কুকুর শুয়েছিল। আমাদের দেখে অন্য কাৎ হলো। চেঁচামেচি আশঙ্কা করেছিলাম, কিন্তু দেখা গেলো তার তেমন আগ্রহ নেই। মধ্যাহ্ন ভোজ চলছিল। আমরা আমন্ত্রিত হলাম। আমার খিদে ছিল না, তবে মনে হলো না খেলে গৃহস্থ অসন্তুষ্ট হতে পারেন। দুটো বড় বড় মাটির থালায় বরবটি সিদ্ধ এলো। সাথে একবাটি অপরিশোধিত মোটা লবণ। সেলিমভাই পিঠ থেকে বোর্ড নামিয়ে ধুমধাম কিছু স্কেচ করে ফেললেন। গৃহকর্তা জানালেন এখানে এমনিতে বাইরের লোক তেমন আসেন না। মাঝে মাঝে কিছু বিদেশী লোকজন এসে জামাকাপড়সাবান ইত্যাদি দিয়ে যান। বেড়ার উপর দেখলাম কোন একটা বিদেশী এন.জি,ও.র পোস্টার। ছবি তোলার ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি করে পরে রাজী হলেন। (ছবি পরে অনেকগুলাই নষ্ট হইছিল। কিছু আছে। তবে স্ক্যান করা নাই )।
ঘন্টাখানেক পরে সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবার ফিরতি পথ। এবার উঠতে হবে খাড়াই বেয়ে। হাঁটু আর কোমড় খুলে যাচ্ছিল পিচ্চিকে ফলো করতে গিয়ে। পরে তাকে বলা হলো তুমি বাড়ি যাও। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাকি রাস্তা আমরা যেতে পারবো। পিচ্চি বলল উপরে তার নাকি কি কাজ আছে। আমি জানতে চাইলাম দিনে কতবার আনুমানিক ওঠানামা করো? বলে এই সাতআটবার! যাই হোক, একটু পর পর বিরতি নিয়ে জয়কে গালি দিতে দিতে একসময় পৌঁছলাম সদর রাস্তায়। খাড়াই বাইতে শুরু করার পরে যতটা ক্লান্ত লাগছিল, শেষের দিকে সেটা একেবারেই ছিল না। শুনেছি বেশী উচ্চতায় কারো কারো শ্বাসকষ্ট হয়, কিন্তু আমি বিগত ঘন্টা তিন শ্রমের পরে অতিরিক্ত সুস্থবোধ করছিলাম। পিচ্চি আঙ্গুল দিয়ে দেখালো কোন রাস্তা ধরে যেতে হবে। এবার উপরে তাকিয়ে দেখলাম, আসল খেইল এখন শুরু। এবার আর পাথুরে নয় পিচঢালা খাড়াই বেয়ে উঠতে হবে। চিম্বুক পাহাড়ের চুড়ায় পৌঁছতে আরো বাইশ কিলোমিটার।
শুরু হলো হেলে দুলে হাঁটা। পাহাড় কাটা রাস্তা কখনো বেশী খাড়াই কখনো হঠাৎ ঢালু। প্যাচানো পথের কখনো ডানে কখনো বাঁয়ে আদিগন্ত পাহাড়; পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল আর তার উপর ভাসমান মেঘের ছায়া। আমার জীবনে প্রথম পাহাড়ে এসে পাহাড় দেখা। বিস্ময় একটু বেশীই ছিল হয়তো। তবে মেঘের দৌড় এরপরেও যতবার দেখেছি রোমাঞ্চিত না হয়ে পারিনি। সেদিন সকালে খানিক বৃষ্টি হলেও বাকি সারাদিন খটখটে রোদ। একটু পর পর তৃষ্ণায় জিভ বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই জলের জোগান শেষ। মাঝে বার দুয়েক পাহাড়িগুল্মরাজিকে খানিক ইউরিয়া দান করা গেলো। সভ্য শহর থেকে ততক্ষণে আমরা বহুদূরে। সেখানে হরতালটরতাল নেই। হরতাল কাকে বলে বোঝার লোকও নেই। শুধু শহর থেকে চান্দের গাড়ি আসা বন্ধ। কিন্তু মালবাহী ট্রাক দেখা যাচ্ছিল খানিক পর পর। বার দুয়েক নজরে পড়লো সেনাবাহিনির গাড়ি। প্রায় প্রতিটাই পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলছে। রাজপুত্রের কথা মনে পড়লো। সম্ভবত অতিসতর্কতাই এইসব সুদৃশ্য জিপের ক্বচিৎ পতনের কারণ।
আরো খানিক এগিয়ে তৃষ্ণায় রীতিমতো পেয়ে বসলো। এবার জয়কে নতুন করে গালি দেওয়া শুরু হলো। একটা বোতলটোতল সাথে থাকলে সেরম ফুয়েল পাওয়া যেতো। কিছুদুর গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে আমি ব্যাগ খুলে দেখি আমার ব্যাগে একখানা প্লাস্টিকের বোতল। তবে পানির। তিনজনের ভাগেজোকে শেষ পর্যন্ত তৃষ্ণাই বাড়লো।
ঘন্টা তিনপরে দেখা যায় দৃশ্যত খানিক দূরে চিম্বুকের চুড়ার সেই গেস্ট হাউসের আবছা আভাস । সেইসাথে শুরু হলো ঠান্ডা বাতাস। বাতাসের তোড়ে হাঁটার গতি বাড়ে। মনে হচ্ছিল এই পাহাড়েই চিরকাল থেকে যাই। সভ্যতাটভ্যতার আর দরকার নাই। নেংটি পড়ে হরিণ মেরে মালটেনে বাকি জীবনটা কেটে যাবে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment