তারপর মোটামুটি মিনিট ত্রিশেক পরে একটা অসমাপ্ত বাজার। সেই বাজারের কোন এক দোকানে বসে চা খাওয়া গেল। তারপর ধীরেসুস্থে নড়েচড়ে রওনা দিলাম গেস্টহাউসের দিকে। গেস্ট হাউসের বারান্দায় উঠে দেখি কেউ নেই আশে পাশে। পাটাতন থেকে নেমে বেশ খানিকটা গেলে তারপর একটা ছোট অফিস মতোন। আমাদের তিনজনকেই তখন ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রকৃতি ডাকছে। আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে উশখুশ করছিলাম, কিভাবে গেস্ট হাউসে রাত্রিবাসের কথাটা পাড়া যায়। জয়ের ভাষ্যমতে এটা যেহেতু মুরং অধ্যুষিত এলাকা, মার্মা রাজার রেফারেন্সে নানান ঝামেলা হতে পারে। সুতরাং সাদামাঠাভাবে এসে পড়েছি রাত্রিবাস করতে চাই জাতীয় অনুরোধই শেষতক স্থির হলো। এদিকে সেলিম ভাই প্রকৃতির উদাত্ত আহবান অস্বীকার করতে না পেরে সোজা চলে গেলেন অফিসের দিকে। সেখানে উর্দিপড়া একজন, তাঁর সাথে হুজুর গোছের টুপি পড়া আরো এক ভদ্রলোক। হুজুর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি ঢাকা থিকা আসছেন? জবাবে আমরা নানাভাবে বোঝালাম বেড়াতে এসে রাত হয়ে গেছে, কোথাও না কোথাও রাতে থাকতে হবে ইত্যাদি। কর্তৃপক্ষ প্রবল আপত্তি তুলে বললেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তালা খোলার অনুমতি নেই। তাছাড়া এখানে অনেক সমস্যা। পানি নেই, বিদ্যুত নেই। আমরা বললাম আমাদের বিদ্যুতের দরকার নেই, শৌচকার্যে অপরিহার্য পরিমাণের বাইরে পানিরও দরকার নেই। বহুমুখী আলোচনার একপর্যায়ে ভদ্রলোক ঘর খুলে দিলেন। বিছানায় একখানা শতচ্ছিন্ন জাজিম। রীতিমতো নারকেলী আঁশের বিস্তৃত দ্বীপপুঞ্জ। আরেক পাশে একখানা তুলনামূলক কম বিধ্বস্ত সোফা। নিচের দোকান থেকে ডজনখানেক মোমবাতি কেনা হয়েছিল। সেই আলোর প্রথম ছটায় আবিস্কার করলাম বাথরূমে পানির সঞ্চয় সাকুল্যে আধা বালতির কিছু কম। সেলিম ভাই অফিস কক্ষের পার্শ্ববর্তী লোকায়ত টাট্টি ঘরে নির্বাণ লাভ করলেও বাকি দুজন তখনো নিয়মিত আহবান নিরবে সয়ে চলেছি। সেদিন কপাল ভালো ছিল। বালতিতে আজলা খানেক বাকি থাকতেই মোক্ষলাভ হলো।
এর মধ্যে সেই হুজুর ভদ্রলোকের নানান প্রশ্ন। প্রথম জিজ্ঞাস্য হচ্ছে নাম। ডাকনাম বলে জয় হালকা ঝাড়ি খেল। কারণ তাতে ধর্মীয় স্টিকার নেই। অত:পর তিনি পাহাড়িদের বিষয়ে আমাদের সাবধান করে দিলেন। পাহাড়িরা তাঁর দৃষ্টিতে অতিশয় বিপজ্জনক। পাহাড়িরা জামা কাপড় কম পড়ে এবং মদ খায়। শুধু পাহাড়িরা না, চিম্বুকের চুড়ার নিচে বাঙ্গালীদের গুটিকয়ঘর বাদে পুরো পাহাড় আর পাহাড়ি জঙ্গলই বিপজ্জনক। সেখানে তাঁর মতে, বাঘ-ভালুক-হাতি ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের "দেও" আছে, যারা দুপেয়েদের নানারকম অপার্থিব ক্ষতি করে থাকেন।
ভদ্রলোক চলে গেলে আমরা পানিয়ের সুলুক সন্ধানে মন দিলাম। কিন্তু অন্ধকার নেমে আসায় ঠিক কোথায় গেলে আব-এ-মৌজ পাওয়া যাবে বোঝা যাচ্ছিল না। গেস্ট হাউসের ঠিক পেছনের ঢালেই আবার অনেকটা এলাকা জুড়ে পুলিশ ছাউনি। বিপরীতে মানে বারান্দা থেকে নিচের দিকে অনেকখানি নেমে পরবর্তী গ্রাম। আমি আর সেলিম ভাই অন্ধকারে পাহাড়ি পথ চলায় অনভিজ্ঞ বলে গেস্ট হাউসে থেকে গেলাম। বারান্দায় বসে প্রায় ঘন্টা তিন আকাশ পাতাল গপ্পো করতে করতে জয় একসময় ফিরলো। খালি হাতে। পেটে না। সামনের গ্রামে গেলাসখানিক জুটেছিল। নিয়ে আসবার মতো পরিমাণ ছিল না। যাই হোক। সোফা থেকে গদী তুলে সেই নারকেল দ্বীপের উপর লম্বমান হওয়া গেল। সারাদিন পথ হেঁটেছি ভাদ্রমাসের গরমে। কিন্তু চিম্বুকের চুড়ায় রাত যত বাড়ছিল কুয়াশা তত গাঢ় হচ্ছিল। সেই সাথে পর্বতের রহস্য বিশাল গ্রাসে গিলে ফেলছিল গোটাতিন অকর্মণ্য স্বপ্নখোর তরুণকে।
চোখে রোদ পড়তে ঘুম ছুটলো। সেলিম ভাই বারান্দায় রেলিঙের উপর বোর্ড নিয়ে বসে গেছে। জয় ভোররাত থেকে আবারো হাওয়া। ঘরের পেছন দিকের জানালা দিয়ে কয়েক ঝাঁক পুলিশের দলবদ্ধ দাঁত মাজা দেখা গেলো। বারান্দায় এসে দেখি দিগন্ত জোড়া পাহাড়। বহুদূরে কেওকারাডঙের আভাস। চিম্বুক পাহাড়কে মাঝে ফেলে দুদিকে চলে গেছে দুটো পাহাড়ি পথ। একটা রূমার দিকে আরেকটা থানছির দিকে। মন খারাপ ছিল। রসদ শেষের দিকে তাছাড়া গেস্ট হাউসও ছাড়তে হবে দুপুরের মধ্যে। কোন এক উর্ধ্বতন কত্তা নাকি বিকেলের মধ্যেই আসবেন। অর্থাৎ বান্দরবান ফিরতে হবে আজই। পাহাড়ে মন মতো আর ঘোরা হবে না। তারপরো অন্তত চোখের সাধ মিটিয়ে চারদিক দেখে নিলাম এই আর কি।
জয় ফিরতে ফিরতে বেলা বারোটা। ব্যাগ কাঁধে তুলে অতৃপ্তির শ্বাস ফেলে চিম্বুক থেকে নেমে এলাম। সামনের হোটেলে বসে অভ্যস্ত ভাততরকারিতে মধ্যাহ্ন ভোজন হলো। হোটেলের উল্টোদিকে একটা মুরং দোকান। সেখানে কয়েক রকম মশক সাজানো ছিল। তালের কিংবা কুমড়ার ছাঁচে বানানো। জয় দাম জিজ্ঞাসা করতে দোকানি জিভটিভ কেটে দিয়ে দিলেন। সেই মশকটা ঢাকায় ফেলে এসেছি। আধুনিক শোপিসের ভিড়ে কখনো বেমানান লাগলেও আমি জোর করে সেটা সব সময় সামনে রাখতাম। সেখানে পাহাড়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বলতে ভুলে গেছি, আগের দিন মুরংদের গ্রাম থেকে জল চাইতে ওরা ঐরকম আরেকটা মশক ভরে দিয়েছিল। সেটা আগেই জয়ের দখলে।
আবার যাত্রা। এবার ঢাল বেয়ে নামা। মনে হচ্ছিল সব কিছু নতুন। কাল কিছুই দেখিনি। দুচোখে পাহাড় গিলতে গিলতে ভাবছিলাম এবার হলো না। আবার কখনো আসবো। নিশ্চয়ই আসবো।
পথে প্ল্যান হচ্ছিল ভবিষ্যতের। একটা কোন দুর্ধর্ষ কিছু করতে হবে পাহাড় নিয়ে। বয়োজেষ্ঠ দুজন আমার উপর ভবিষ্যতে চাকরিবাকরি করে টাকা জমানোর দায় চাপালেন। উদ্দেশ্য একটা জিপ আর একটা জবরদস্ত মুভিক্যামেরা কিনতে হবে। সেলিম ভাইয়ের স্কেচ আর জয়ের স্ক্রিপ্ট মিলিয়ে একটা ফাটাফাটি কিছু করতে হবে। তারপর চলে গেলো একদশকের মতো। আমরা বুড়ো হচ্ছি আর সরে যাচ্ছি। সরে যাচ্ছে পাহাড়গুলিও। সরিসৃপ পড়ে আছি বিমর্ষ সমতলে।
(চলবে?)
এর মধ্যে সেই হুজুর ভদ্রলোকের নানান প্রশ্ন। প্রথম জিজ্ঞাস্য হচ্ছে নাম। ডাকনাম বলে জয় হালকা ঝাড়ি খেল। কারণ তাতে ধর্মীয় স্টিকার নেই। অত:পর তিনি পাহাড়িদের বিষয়ে আমাদের সাবধান করে দিলেন। পাহাড়িরা তাঁর দৃষ্টিতে অতিশয় বিপজ্জনক। পাহাড়িরা জামা কাপড় কম পড়ে এবং মদ খায়। শুধু পাহাড়িরা না, চিম্বুকের চুড়ার নিচে বাঙ্গালীদের গুটিকয়ঘর বাদে পুরো পাহাড় আর পাহাড়ি জঙ্গলই বিপজ্জনক। সেখানে তাঁর মতে, বাঘ-ভালুক-হাতি ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের "দেও" আছে, যারা দুপেয়েদের নানারকম অপার্থিব ক্ষতি করে থাকেন।
ভদ্রলোক চলে গেলে আমরা পানিয়ের সুলুক সন্ধানে মন দিলাম। কিন্তু অন্ধকার নেমে আসায় ঠিক কোথায় গেলে আব-এ-মৌজ পাওয়া যাবে বোঝা যাচ্ছিল না। গেস্ট হাউসের ঠিক পেছনের ঢালেই আবার অনেকটা এলাকা জুড়ে পুলিশ ছাউনি। বিপরীতে মানে বারান্দা থেকে নিচের দিকে অনেকখানি নেমে পরবর্তী গ্রাম। আমি আর সেলিম ভাই অন্ধকারে পাহাড়ি পথ চলায় অনভিজ্ঞ বলে গেস্ট হাউসে থেকে গেলাম। বারান্দায় বসে প্রায় ঘন্টা তিন আকাশ পাতাল গপ্পো করতে করতে জয় একসময় ফিরলো। খালি হাতে। পেটে না। সামনের গ্রামে গেলাসখানিক জুটেছিল। নিয়ে আসবার মতো পরিমাণ ছিল না। যাই হোক। সোফা থেকে গদী তুলে সেই নারকেল দ্বীপের উপর লম্বমান হওয়া গেল। সারাদিন পথ হেঁটেছি ভাদ্রমাসের গরমে। কিন্তু চিম্বুকের চুড়ায় রাত যত বাড়ছিল কুয়াশা তত গাঢ় হচ্ছিল। সেই সাথে পর্বতের রহস্য বিশাল গ্রাসে গিলে ফেলছিল গোটাতিন অকর্মণ্য স্বপ্নখোর তরুণকে।
চোখে রোদ পড়তে ঘুম ছুটলো। সেলিম ভাই বারান্দায় রেলিঙের উপর বোর্ড নিয়ে বসে গেছে। জয় ভোররাত থেকে আবারো হাওয়া। ঘরের পেছন দিকের জানালা দিয়ে কয়েক ঝাঁক পুলিশের দলবদ্ধ দাঁত মাজা দেখা গেলো। বারান্দায় এসে দেখি দিগন্ত জোড়া পাহাড়। বহুদূরে কেওকারাডঙের আভাস। চিম্বুক পাহাড়কে মাঝে ফেলে দুদিকে চলে গেছে দুটো পাহাড়ি পথ। একটা রূমার দিকে আরেকটা থানছির দিকে। মন খারাপ ছিল। রসদ শেষের দিকে তাছাড়া গেস্ট হাউসও ছাড়তে হবে দুপুরের মধ্যে। কোন এক উর্ধ্বতন কত্তা নাকি বিকেলের মধ্যেই আসবেন। অর্থাৎ বান্দরবান ফিরতে হবে আজই। পাহাড়ে মন মতো আর ঘোরা হবে না। তারপরো অন্তত চোখের সাধ মিটিয়ে চারদিক দেখে নিলাম এই আর কি।
জয় ফিরতে ফিরতে বেলা বারোটা। ব্যাগ কাঁধে তুলে অতৃপ্তির শ্বাস ফেলে চিম্বুক থেকে নেমে এলাম। সামনের হোটেলে বসে অভ্যস্ত ভাততরকারিতে মধ্যাহ্ন ভোজন হলো। হোটেলের উল্টোদিকে একটা মুরং দোকান। সেখানে কয়েক রকম মশক সাজানো ছিল। তালের কিংবা কুমড়ার ছাঁচে বানানো। জয় দাম জিজ্ঞাসা করতে দোকানি জিভটিভ কেটে দিয়ে দিলেন। সেই মশকটা ঢাকায় ফেলে এসেছি। আধুনিক শোপিসের ভিড়ে কখনো বেমানান লাগলেও আমি জোর করে সেটা সব সময় সামনে রাখতাম। সেখানে পাহাড়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বলতে ভুলে গেছি, আগের দিন মুরংদের গ্রাম থেকে জল চাইতে ওরা ঐরকম আরেকটা মশক ভরে দিয়েছিল। সেটা আগেই জয়ের দখলে।
আবার যাত্রা। এবার ঢাল বেয়ে নামা। মনে হচ্ছিল সব কিছু নতুন। কাল কিছুই দেখিনি। দুচোখে পাহাড় গিলতে গিলতে ভাবছিলাম এবার হলো না। আবার কখনো আসবো। নিশ্চয়ই আসবো।
পথে প্ল্যান হচ্ছিল ভবিষ্যতের। একটা কোন দুর্ধর্ষ কিছু করতে হবে পাহাড় নিয়ে। বয়োজেষ্ঠ দুজন আমার উপর ভবিষ্যতে চাকরিবাকরি করে টাকা জমানোর দায় চাপালেন। উদ্দেশ্য একটা জিপ আর একটা জবরদস্ত মুভিক্যামেরা কিনতে হবে। সেলিম ভাইয়ের স্কেচ আর জয়ের স্ক্রিপ্ট মিলিয়ে একটা ফাটাফাটি কিছু করতে হবে। তারপর চলে গেলো একদশকের মতো। আমরা বুড়ো হচ্ছি আর সরে যাচ্ছি। সরে যাচ্ছে পাহাড়গুলিও। সরিসৃপ পড়ে আছি বিমর্ষ সমতলে।
(চলবে?)
No comments:
Post a Comment