Wednesday, July 23, 2008

টোপ দিলেই যে কেঁচো মাছ খেয়ে ফেলবে তার গ্যারান্টি কী? ১১

সেইদিন ঠিক কোন সময় কিভাবে মুমুদের বাড়ি ফিরেছিলাম তার স্মৃতি অস্পষ্ট। মনে আছে মাসীর ঘর থেকে বের হয়ে বান্দরবান শহরে সন্ধ্যার ঝিরঝিরে বাতাসে ইজি লাগবার কথা। মংশাই বললো এইখানে মাতলামী করলেও অসুবিধা নাই। কেউ কিছু বলবে না। উস্টা খেয়ে পড়লে জনগণ বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমরা ভরসা পেলাম। রাজার হবু শালা বলে কথা।

কেউ কেউ বলেন ঝিরঝিরে বাতাসে নেশা কাটে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, তাঁরা ভুল বলেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখি আদুরে আবহাওয়ায় বরং পিনিক গাঢ় হয়, গভীরতর পাতকুয়ার নিভৃতে জম্পেশ কিম্বা টস্ টসে পরমার্থের সন্ধান পেয়ে নি:শঙ্ক চিত্তে কচ্ করে বালতির দড়ি কেটে দেন।

চারজনে সেভাবেই হাঁটার ভঙ্গীতে নড়চড়ে বেড়াচ্ছিলাম পিনিকের প, ন, ক'য়ের আঁকেবাঁকে ক্লিফহ্যাঙ্গার হয়ে। মাঝেমধ্যে পরস্পরকে হুতোমহাসি মুখ করে দেখে নিয়ে নিশ্চিত হচ্ছিলাম উৎক্ষেপণ থেকে প্রক্ষেপণ কালের কক্ষপথ। কোরাস চলছিল তখনো। নিশিথ নিরজনে পার হয়ে তখন রংবাজে উত্তরণ ঘটেছে। সেলিম ভাই চমৎকার করে গাইছিলেন,

শিকারী শিকার খোঁজে বোতলে মাতাল
লাইটপোস্ট তুমি খোঁজ কারে?

রাজবাড়ি পেরিয়ে আবার চলে আসি ঘুরতে ঘুরতে শহরের আরেকপ্রান্তে। একদিকে অসমাপ্ত শহর আরেকদিকে ঢাল বেয়ে পাহাড় নেমে গেছে শঙ্খ নদীতে। সেখানে অমাবশ্যা রাতে ইলেকট্রিক পুর্নিমার ছায়ায় নির্লিপ্ত শুয়োরগুলির গম্ভীর পায়চারী চোখে পড়ে।

আমি গলা খুলে আবৃত্তি করি বহুদিন পর কিম্বা জীবনে প্রথম আর শেষবার,

হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মাগার জমিনে বান্ধা পাও

আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস্ না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্ থি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার। ..........



--------------------------------------------------------------------------------


পরদিন আটটার দিকে চোখ খুলে দেখি বাকিরা খানিক আগেই গাত্রোত্থান করে চা-চু খাচ্ছে। মুমু কি যেন একটা জরুরি কাজে চট্টগ্রাম যাবে। আমার চা শেষ হতে হতে সিদ্ধান্ত হলো, ঠিকাছে, আজকে আমরা রামু থেকে ঘুরে আসি, কাল সক্কাল সক্কাল রাঙামাটির দিকে রওনা দেওয়া যাবে। আধাঘন্টার মধ্যে বের হয়ে রামুর বাস ধরলাম।

বান্দরবান শহর থেকে হৈ হৈ করে বেরিয়ে নানান প্যাচঘোঁচ পার হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে এসে একটু ইজি হয়ে বসতে না বসতে শুনি আরেক কাহিনি। রামু থেকে নাকি দুপুরের পরে আর বান্দরবান ফেরার বাস নেই। সামনের সীটের কোন উপবিষ্টার সাথে কখনো ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে কখনো সিলি পয়েন্টে কখনো সীটে হেলান দিয়ে শর্ট থার্ডম্যান থেকে ফিল্ডিং করে যাচ্ছিলাম, ফেরার বাস নেই শুনে থতমত খেয়ে ক্যাচ মিস করলাম। রামু থেকে রাতে ফিরতে না পারলে কি হবে? জয় আবার আমাকে খোঁচা দিয়ে বলে রামুর আশেপাশে নাকি চিতাবাঘ আছে। রাতে ফেরার উপায় না হলে দুয়েকটার সাথে দেখাটেখাও হতে পারে।
যেই ভদ্রলোক এই খবর দিলেন তাঁকে খুব করে ধরা হলো এর একটা কোন উপায় বের করতে। তিনি ভেবেচিন্তে বললেন, (আমাদের প্যাকেট থেকে গোটা তিন বিড়ি ফুঁকে) আপনারা এক কাজ করেন, সোজা এই বাস ধইরা কক্সবাজার চইলা যান ...তারপর সেইখান থিকা সোজা তেইশ মাইল বাজারে আইসা পড়েন। তারপর টেম্পো থাকলে টেম্পো দিয়া নাইলে বেবিট্যাক্সি দিয়া বান্দরবান ফিরতে পারবেন। সেই ক্লাস টুতে থাকতে "আমার বইতে" পড়েছিলাম, রামুতে বৌদ্ধ মঠ আছে...সেই মঠ আর দেখা হলো না। তার বদলে বারোটা থেকে আড়াইটা, এই ফাঁকের মধ্যে অতি সংক্ষেপে সমুদ্রটা দেখা হয়ে যাবে।

কক্সবাজার পৌছলাম বেলা পৌনে বারোটার দিকে। সমুদ্রে নামার কাপড়চোপড় তো নাই। জাঈঙ্গা পড়ে নামা যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে আলাদা পলিথিনে করে ভেজা অন্তর্বাস কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সুতরাং রিক্সা নিয়ে তিনজন ছুটলাম বার্মিজ বাজারে। রিক্সাচালক খুব রসিক। আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন রাতে কোথায় থাকবো? আমরা বললাম জানি না। ভদ্রলোক দ্বিগুণ উৎসাহে জানতে চাইলেন ভাবী সঙ্গে আছে কি না। নেতিবাচক জবাবে তিনি আরো তিনগুণ উৎসাহিত হয়ে বললেন তাইলে ভাবীওয়ালা হোটেলে নিয়া যাই? জিজ্ঞাসা করলাম ভাবীওয়ালা হোটেল কী? ভদ্রলোকের মুখে রহস্যময় হাসি।

বার্মিজ বাজারে দুই চক্কর মেরে সবচাইতে কম দামের তিনপিস শর্টস নিয়ে চলে এলাম সমুদ্রের তীরে। আদর্শ সময়। জোয়ার চলছে। দুইটা বন্ধ চটপটির গাড়ির মাঝামাঝি কায়দা করে গেঞ্জি-প্যান্ট-অন্তর্বাস খুলে শর্টস পড়া গেলো। তারপর সীবীচের পাশের একটা কনফেকশনারীতে অনুরোধ করে আমাদের গাট্টি-বোঁচকা জমা রাখা হলো। বাই চান্স যদি ঐ লোক দোকান বন্ধ করে ভাগলে ত্রিমুর্তির নাগা সন্ন্যাসী হওয়া ছাড়া আর গতি নেই।

দোকান্দারের প্রতি অগাধ আস্থা রেখে নেমে পড়লাম পানিতে। জোয়ারের সময় সমুদ্রে নামতে সাঁতার জানা জরুরি না। ঘন্টা খানেক হুটোপুটি চললো। সী-বীচের ফটোশিকারীরা ছবি তোলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। জয়ের হাতে ছোট্ট অটোমেটিক ক্যামেরাটা দেখে একজন বলল, ঐ বাচ্চা ক্যামেরায় কী ছবি তুলবেন? জয় বলল, এটা আসলে বাচ্চা ক্যামেরা না, এটা ক্যামেরার বাচ্চা। এর থেকে যা জন্ম নেবে সেগুলো ছবির বাচ্চা।

পানি থেকে উঠে গিয়ে ছাতার নীচে চিৎ হতে গেলে বীচের গোটাদুই কর্মচারী হা হা করে ছুটে এলো। ওগুলি নাকি আগে থেকে বুক করতে হয়। আমরা আপাতত খানকয়েক সিগারেটে আধা ঘন্টার মতো চিৎ-কাইৎ হবার ব্যাবস্থা করা গেলো। কিছুক্ষণ শোনা গেল বীচের ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে তাঁদের বিষোদগার। আমরা শ্রেণীসংগ্রামের সার্বজনীনতায় নিশ্চিন্ত হলাম।

কপালে ঠাডা পড়লে যা হয় আর কি! চট্টগ্রামগামী বাস তেইশমাইল বাজারে পৌছবার বেশ খানিক আগেই অক্কা পেল। তাও একেবারে জাগামতো। দুই দিকে গভীর অরণ্য। সন্ধ্যা আসি আসি করছে। বাসের যাত্রী সব মিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক হবে। তাঁদের হাউকাউতে কেটে গেলো আরো আধাঘন্টা। ড্রাইভার জানালো ঝুঁকি নিয়ে আরো খানিকটা চলা সম্ভব। সামনে নাকি কোথায় একটা টেম্পোস্ট্যান্ড আছে সেখান থেকে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। মিনিট পনের জান হাতে নিয়ে এগোবার পরে সেই টেম্পোস্ট্যান্ডে আসা গেলো। গোটা পাঁচেক টেম্পো ছিল, চোখের নিমেষে সব লোপাট। পরে আরো দুটো আসলে সেগুলিও। জনৈক বশীর সাহেবকে পাওয়া গেল যিনি তেইশমাইল বাজারে যেতে চান। তিনি কোত্থেকে একটা বেবীট্যাক্সি ম্যানেজ করলেন। তাতে উঠে পড়লাম চারজন। পথে নামলো ধুন্ধুমার বৃষ্টি। তারপর তেইশ মাইল বাজারে চুপচুপে ভিজে ত্রিমুর্তি ভোদাই হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রায় ঘন্টাখানেক। প্রায় দ্বিগুণ ভাড়ায় কোনরকমে একটা মিশুককে বান্দরবান যেতে রাজী করা হলো। ঝুমঝুম বৃষ্টির সেই খাড়াই রাস্তায় শেষ পর্যন্ত আছাড় না খেয়েই রাত পৌনে দশটা নাগাদ পৌছলাম মুমুদের বাড়ি।

(চলবে)

No comments: