শেষের খানিকটা পথ ট্রাকে চলে এলাম। বান্দরবানে ঢোকার আধাঘন্টার মতো আগে সামনে ইটের দেওয়ালে চিকা মারা দেখে বুঝলাম সভ্য জগতে এসে গেছি। যেখানে গতকাল সকালে হরতাল ছিল।
শহরে ঢুকবার পরে লোকমুখে শোনা গেল হরতাল আরো একদিন আগে বেড়েছে। কারণ সাদেক হোসেন খোকার নাকি গুলি লেগেছে। গত দুদিন প্রকৃত মানুষের জগত থেকে ফিরে এইসব কচকচি আর ভাল্লাগছিল না। আমরা বান্দরবান শহরে এসে যখন নেমেছি তখন প্রায় সন্ধ্যা ছটা বাজে। ফেরার পথে ভাবছিলাম আজকে যে করেই হোক শুস্কতার অবসান ঘটাতে হবে।
মুমুদের বাড়ি ফেরার পরে দেখি মংশাই এর ঘরে নানারকম গেস্ট। অর্থাৎ মালের জোগাড় আজো সমস্যার মুখে। কারণ প্রকৃত সওদাগরের খোঁজ নিজেরা বের করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর তিনজনই ক্লান্ত। মুমুদের বাড়ি ঢুকতেও তেমন গায়ে লাগছিল না। ঘরে ঢুকে সাজানো গোছানো বিছানা দেখেই ঘুম চ্যাগা দিয়ে উঠলো। আবারো সুস্বাদু বাঁশ(কচি বাঁশের চচ্চরি) খেয়ে বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে প্রকৃতি কানে ধরে ডেকে পাঠালো। তাঁকে খুশী করে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি জয় আর সেলিম ভাই হাওয়া। কেমনে কী? মাথায় ছোট্ট একটা ঢিল পড়তে দেখি ওরা ছাদে। কিছুটা পেয়ারা গাছ আর কিছুটা রেলিঙ বেয়ে উঠলাম। বান্দরবান থেকে ফেরার পথে করা পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলি নিয়ে আলাপ চলছিল। কিভাবে কোন কোন জায়গায় শুটিং হবে, কারা কারা কিন্তে পারে, কিনে ফেলে তখন আমাদের কি দশা হবে আমরা তখন পুরনো জিপ বেচে হুভারক্রাফট কিনে ফেলবো। তারপর কোন একদিন হুভারক্রাফট বেচে তারপরে বাজারে যা আসবে তেমন একটা কিছু ..সব মিলিয়ে রীতিমতো একটা পরিস্থিতি। বাকির মধ্যে শুধু শুরু করে দেবার মতো জিপ আর ক্যামেরার টাকা, ভাবনাসহায়ক হিসেবে কিঞ্চিৎ পানীয় আর ধোঁয়া বলতে শুধু কয়েক শলা গোল্ডলীফ ছাড়া আর কিছু না থাকা।
একসময় ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। আমরা আবার চাদরের নিচে গেলাম। বেলা দশটার দিকে মংশাই ডেকে তুললো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র। দুর্দান্ত ফটোগ্রাফার। ক্যামেরাটা কী তা জানি না তবে অবয়ব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তাঁর গুরুত্ব। বান্দরবান আর খাগড়াছড়িতে তোলা ওর ছবি দেখলাম গোটা তিন অ্যালবাম। আমার ব্যাগে থাকা ভিভ্যাটর আর জয়ের পকেটে মিনোলটা অটোমেটিক ক্যামেরাগুলিকে খেলনা মনে হচ্ছিল। সেলিম ভাইয়েরটা ভালো হলেও মংশাইয়ের ধারে কাছেও না।
সেদিন দুপুরে বেশ ভুড়িভোজ হলো। এর আগের দুদিন শাকসব্জি আর সাঙ্গু নদীর মাছ খাওয়া হয়েছিল। আজ হাঙরের চচ্চরির সাথে বাঙালী পদ্ধতির ডাল(শুকনো মরিচ দিয়ে) রীতিমতো মুখে অমৃতের স্বাদ এনে দিলো।সেই বাঁশও ছিল। সেটাও অপূর্ব। অভূতপূর্ব তো বটেই।
দেড়টার দিকে মংশাই নিজেই প্রস্তাব দিলো চলো ঘুরেটুরে আসি শহরে। বান্দরবান শহরের এমাথাওমাথা করতে খুব বেশী হলে দুঘন্টা লাগে। হরতাল থাকায় শহরের বেশীরভাগ রাস্তা খালি। কোথাও কোথাও রিক্সা দেখা যায় মাঝে মধ্যে। মুমুদের বাড়ি থেকে একশো মিটারের মতো দূরে শহর শেষ হয়ে একটা খাড়াই নেমে সোজা মিশে গেছে সাঙ্গু নদীতে। খাড়াই এর গায়ে গায়ে নানা কায়দায় খাঁজ কাটা। তারপরো নামতে বুক কাঁপছিল। একবার ফস্কে গেলেই জাহাঙ্গীরনগরে কমপক্ষে একটা মিলাদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ন্যুনতম তবারকসহ। তবে পারলাম শেষ পর্যন্ত নদীর তীর পর্যন্ত যেতে। পাহাড়ী নদীর সাথে সমতলের নদীর পার্থক্য মৌলিক। পাহাড়ে স্রোতের স্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। নদীর পাড় দিয়ে বেশ কিছু শুয়োর ইত:স্তত হাঁটছিল। এরা নিরিহ শুয়োর। আমাদের পাশ দিয়ে যাবার পথে একজন নিলিপ্ত দৃষ্টিতে দেখে গেলো। হয়তো ভালো করেই জানে কোন না কোন একদিন এইসব দুপেয়েদের পেটেই যেতে হবে। তারপরো ভাবলেশহীন। দেখে শ্রদ্ধা হয়।
নদীর তীর ঘেঁষে পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে একময় হাতের ডানে পাহাড়ের খাঁজে কয়েকটা বাঁশের ঘর দেখা গেলো বিশাল বিশাল খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে। তার পাশ দিয়ে আবার খাঁজ কাটা রাস্তা সোজা উঠে গেছে ঘরের পাটাতনের দিকে। মংশাই ইশারা করলো ইহাই আমাদীগের গন্তব্য। খাঁজ বেয়ে নামতে যতটা কষ্ট হয়েছিল উঠতে ততটা হয়নি। সেখানে থাকেন এক মাসী। দেখে অবশ্য মাতামহীর চাইতেও বয়স্ক মনে হয়। তাঁর ঘরে গিয়ে বসলাম তিনজনে। বাঁশের ঘর। স্নিগ্ধ ঠান্ডা কাঠের পাটাতন। একপাশে জানালা। পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। মেঘও দেখা যাচ্ছে চুড়া থেকে খানিক বেঁটে, বলা যায় সারি সারি মেঘ একের পর এক পাহাড়ের গর্দান নিয়ে চলেছে।
মাসীর ঘরের এককোনায় দুটো মটকা। প্রমিত বাংলায় যাকে ঘড়া বলে আর কি। সেখান থেকে মগ ভরে ভরে তুলে দিলেন প্রথমে তিনটা গেলাসে। তারপর আরো গোটা তিন কোকাকোলার দেড় লিটারের বোতল ভরে এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে। বোতল প্রতি পঞ্চাশ টাকা, প্রথম গেলাস ফাউ। ফাউ উড়ে গেল এক নি:শ্বাসে। বাইরে থেকে অর্ডার দিয়ে বড় এক বাটি গোমাংস এলো। ভুনা। বেশ ঝাল ঝাল। পাহাড়ি রাস্তায় ঘন্টা তিন হেঁটে পেটে এমনিতেই ক্ষুধা ছিল। তার উপর অনুপান পড়ায় সবাই হামলে পড়লাম মানুষের হাতে নিহত হতভাগা কোন গোসন্তানের মাংসের উপর।
সেই বাটি, যাকে বাটি না বলে ছোট হাড়ি বলাই ভালো, ফুরুৎ করে খালি হয়ে গেলো সেই সাথে পৌনে দুই বোতল চোয়ানি। টাল হবার প্রশ্নই আসে না। রীতিমতো ভালো লাগছিল। সেলিমভাই বসেছিল জানালা ঘেঁষে। তাঁর মুখে কোন কথা নেই চুপচাপ গিলে চলেছেন। জয় শুরু করলো ইউপিডিএফ-জেএসএস রাজনীতির আলোচনা। আমি শুধুই শ্রোতা। আমার কাজ গুণ টেনে যাওয়া। নাইলে নৌকা মাঝ নদীতেই গেঁথে থাকবে টাস্কি লেগে। তো নৌকা চালু রাখতে গিয়ে সেই তিন বোতল পেরিয়ে আরো দুবোতল তোলা হলো। মংশাই আসার সময় থেকেই বলছিল একটা নতুন কিছু খাওয়াবে। পঞ্চম বোতল খোলার মুখে সেই নতুন কিছু এলো। পেয়াঁজ আর শুকনো মরিচে মাখানো হাঙ্গরের শুটকিভর্তা। রীতিমতো অমৃতের উর্ধ্বতন জেষ্ঠ্য পিতামহ! তর্জনীর ডগায় করে মুখে দিচ্ছিলাম আর ঝাঁঝ বের হচ্ছিল কান দিয়ে। জয়নুল আবেদীনের গুণটানা ছবি এবার ফার্স্ট ফরোয়ার্ডে চলতে শুরু করলো। পঞ্চম থেকে অষ্টম বোতলের শুরু পর্যন্ত উড়ে গেল জয়সুরিয়ার পিঞ্চহিটিঙের মতো। সেলিম ভাই জিজ্ঞাসা করছিলেন, কখন বুঝবি যে তুই টাল? বলেছিলাম, যতক্ষণ জানালা দিয়া পাহাড় দেখা যাইবো ততক্ষণ ঠিকাছে। তো পাহাড় মশাই তখনো সেখানে বহাল তবিয়তে। মেঘগুলি পালিয়েছে। পাহাড়ের চুড়ায় বিকালের ঠিকরে পড়া পড়ন্ত রোদ আর পেটভর্তি আব-এ-দিলখুশ্ সব মিলিয়ে এইবার ভাল্লাগা শুরু হলো। পরবর্তী বোতলের জন্য খানিক পাপড় ভাঁজা ছাড়া আর কিছু নাই। নবম বোতল শেষ। এইবার জয় ক্ষ্যামা দিলো পার্বত্য রাজনীতিতে। শুরু হলো গান। নানারকম গান। তাল সে তাল মিলা থেকে শুরু করে বিপিন বাবুর কারন সুধা, এই তো জীবন, মুঝে দুনিয়া ওয়ালো শারাবী না সমঝো, নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে, শিকারী শিকার করে বোতলে মাতাল এইরকম বহুগুচ্ছ সুরসপ্তক। তবে সুপার হিট ছিল প্রাচ্যনাটের
"নিশিথ নিরজনে গুফনে গুফনে
করিবো প্যামের আলাপন
এদেহ যৈবন করিব অর্পন
যদি পাই বন্ধুর দরশন"
(চলবে)
শহরে ঢুকবার পরে লোকমুখে শোনা গেল হরতাল আরো একদিন আগে বেড়েছে। কারণ সাদেক হোসেন খোকার নাকি গুলি লেগেছে। গত দুদিন প্রকৃত মানুষের জগত থেকে ফিরে এইসব কচকচি আর ভাল্লাগছিল না। আমরা বান্দরবান শহরে এসে যখন নেমেছি তখন প্রায় সন্ধ্যা ছটা বাজে। ফেরার পথে ভাবছিলাম আজকে যে করেই হোক শুস্কতার অবসান ঘটাতে হবে।
মুমুদের বাড়ি ফেরার পরে দেখি মংশাই এর ঘরে নানারকম গেস্ট। অর্থাৎ মালের জোগাড় আজো সমস্যার মুখে। কারণ প্রকৃত সওদাগরের খোঁজ নিজেরা বের করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর তিনজনই ক্লান্ত। মুমুদের বাড়ি ঢুকতেও তেমন গায়ে লাগছিল না। ঘরে ঢুকে সাজানো গোছানো বিছানা দেখেই ঘুম চ্যাগা দিয়ে উঠলো। আবারো সুস্বাদু বাঁশ(কচি বাঁশের চচ্চরি) খেয়ে বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে প্রকৃতি কানে ধরে ডেকে পাঠালো। তাঁকে খুশী করে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি জয় আর সেলিম ভাই হাওয়া। কেমনে কী? মাথায় ছোট্ট একটা ঢিল পড়তে দেখি ওরা ছাদে। কিছুটা পেয়ারা গাছ আর কিছুটা রেলিঙ বেয়ে উঠলাম। বান্দরবান থেকে ফেরার পথে করা পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলি নিয়ে আলাপ চলছিল। কিভাবে কোন কোন জায়গায় শুটিং হবে, কারা কারা কিন্তে পারে, কিনে ফেলে তখন আমাদের কি দশা হবে আমরা তখন পুরনো জিপ বেচে হুভারক্রাফট কিনে ফেলবো। তারপর কোন একদিন হুভারক্রাফট বেচে তারপরে বাজারে যা আসবে তেমন একটা কিছু ..সব মিলিয়ে রীতিমতো একটা পরিস্থিতি। বাকির মধ্যে শুধু শুরু করে দেবার মতো জিপ আর ক্যামেরার টাকা, ভাবনাসহায়ক হিসেবে কিঞ্চিৎ পানীয় আর ধোঁয়া বলতে শুধু কয়েক শলা গোল্ডলীফ ছাড়া আর কিছু না থাকা।
একসময় ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। আমরা আবার চাদরের নিচে গেলাম। বেলা দশটার দিকে মংশাই ডেকে তুললো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র। দুর্দান্ত ফটোগ্রাফার। ক্যামেরাটা কী তা জানি না তবে অবয়ব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তাঁর গুরুত্ব। বান্দরবান আর খাগড়াছড়িতে তোলা ওর ছবি দেখলাম গোটা তিন অ্যালবাম। আমার ব্যাগে থাকা ভিভ্যাটর আর জয়ের পকেটে মিনোলটা অটোমেটিক ক্যামেরাগুলিকে খেলনা মনে হচ্ছিল। সেলিম ভাইয়েরটা ভালো হলেও মংশাইয়ের ধারে কাছেও না।
সেদিন দুপুরে বেশ ভুড়িভোজ হলো। এর আগের দুদিন শাকসব্জি আর সাঙ্গু নদীর মাছ খাওয়া হয়েছিল। আজ হাঙরের চচ্চরির সাথে বাঙালী পদ্ধতির ডাল(শুকনো মরিচ দিয়ে) রীতিমতো মুখে অমৃতের স্বাদ এনে দিলো।সেই বাঁশও ছিল। সেটাও অপূর্ব। অভূতপূর্ব তো বটেই।
দেড়টার দিকে মংশাই নিজেই প্রস্তাব দিলো চলো ঘুরেটুরে আসি শহরে। বান্দরবান শহরের এমাথাওমাথা করতে খুব বেশী হলে দুঘন্টা লাগে। হরতাল থাকায় শহরের বেশীরভাগ রাস্তা খালি। কোথাও কোথাও রিক্সা দেখা যায় মাঝে মধ্যে। মুমুদের বাড়ি থেকে একশো মিটারের মতো দূরে শহর শেষ হয়ে একটা খাড়াই নেমে সোজা মিশে গেছে সাঙ্গু নদীতে। খাড়াই এর গায়ে গায়ে নানা কায়দায় খাঁজ কাটা। তারপরো নামতে বুক কাঁপছিল। একবার ফস্কে গেলেই জাহাঙ্গীরনগরে কমপক্ষে একটা মিলাদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ন্যুনতম তবারকসহ। তবে পারলাম শেষ পর্যন্ত নদীর তীর পর্যন্ত যেতে। পাহাড়ী নদীর সাথে সমতলের নদীর পার্থক্য মৌলিক। পাহাড়ে স্রোতের স্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। নদীর পাড় দিয়ে বেশ কিছু শুয়োর ইত:স্তত হাঁটছিল। এরা নিরিহ শুয়োর। আমাদের পাশ দিয়ে যাবার পথে একজন নিলিপ্ত দৃষ্টিতে দেখে গেলো। হয়তো ভালো করেই জানে কোন না কোন একদিন এইসব দুপেয়েদের পেটেই যেতে হবে। তারপরো ভাবলেশহীন। দেখে শ্রদ্ধা হয়।
নদীর তীর ঘেঁষে পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে একময় হাতের ডানে পাহাড়ের খাঁজে কয়েকটা বাঁশের ঘর দেখা গেলো বিশাল বিশাল খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে। তার পাশ দিয়ে আবার খাঁজ কাটা রাস্তা সোজা উঠে গেছে ঘরের পাটাতনের দিকে। মংশাই ইশারা করলো ইহাই আমাদীগের গন্তব্য। খাঁজ বেয়ে নামতে যতটা কষ্ট হয়েছিল উঠতে ততটা হয়নি। সেখানে থাকেন এক মাসী। দেখে অবশ্য মাতামহীর চাইতেও বয়স্ক মনে হয়। তাঁর ঘরে গিয়ে বসলাম তিনজনে। বাঁশের ঘর। স্নিগ্ধ ঠান্ডা কাঠের পাটাতন। একপাশে জানালা। পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। মেঘও দেখা যাচ্ছে চুড়া থেকে খানিক বেঁটে, বলা যায় সারি সারি মেঘ একের পর এক পাহাড়ের গর্দান নিয়ে চলেছে।
মাসীর ঘরের এককোনায় দুটো মটকা। প্রমিত বাংলায় যাকে ঘড়া বলে আর কি। সেখান থেকে মগ ভরে ভরে তুলে দিলেন প্রথমে তিনটা গেলাসে। তারপর আরো গোটা তিন কোকাকোলার দেড় লিটারের বোতল ভরে এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে। বোতল প্রতি পঞ্চাশ টাকা, প্রথম গেলাস ফাউ। ফাউ উড়ে গেল এক নি:শ্বাসে। বাইরে থেকে অর্ডার দিয়ে বড় এক বাটি গোমাংস এলো। ভুনা। বেশ ঝাল ঝাল। পাহাড়ি রাস্তায় ঘন্টা তিন হেঁটে পেটে এমনিতেই ক্ষুধা ছিল। তার উপর অনুপান পড়ায় সবাই হামলে পড়লাম মানুষের হাতে নিহত হতভাগা কোন গোসন্তানের মাংসের উপর।
সেই বাটি, যাকে বাটি না বলে ছোট হাড়ি বলাই ভালো, ফুরুৎ করে খালি হয়ে গেলো সেই সাথে পৌনে দুই বোতল চোয়ানি। টাল হবার প্রশ্নই আসে না। রীতিমতো ভালো লাগছিল। সেলিমভাই বসেছিল জানালা ঘেঁষে। তাঁর মুখে কোন কথা নেই চুপচাপ গিলে চলেছেন। জয় শুরু করলো ইউপিডিএফ-জেএসএস রাজনীতির আলোচনা। আমি শুধুই শ্রোতা। আমার কাজ গুণ টেনে যাওয়া। নাইলে নৌকা মাঝ নদীতেই গেঁথে থাকবে টাস্কি লেগে। তো নৌকা চালু রাখতে গিয়ে সেই তিন বোতল পেরিয়ে আরো দুবোতল তোলা হলো। মংশাই আসার সময় থেকেই বলছিল একটা নতুন কিছু খাওয়াবে। পঞ্চম বোতল খোলার মুখে সেই নতুন কিছু এলো। পেয়াঁজ আর শুকনো মরিচে মাখানো হাঙ্গরের শুটকিভর্তা। রীতিমতো অমৃতের উর্ধ্বতন জেষ্ঠ্য পিতামহ! তর্জনীর ডগায় করে মুখে দিচ্ছিলাম আর ঝাঁঝ বের হচ্ছিল কান দিয়ে। জয়নুল আবেদীনের গুণটানা ছবি এবার ফার্স্ট ফরোয়ার্ডে চলতে শুরু করলো। পঞ্চম থেকে অষ্টম বোতলের শুরু পর্যন্ত উড়ে গেল জয়সুরিয়ার পিঞ্চহিটিঙের মতো। সেলিম ভাই জিজ্ঞাসা করছিলেন, কখন বুঝবি যে তুই টাল? বলেছিলাম, যতক্ষণ জানালা দিয়া পাহাড় দেখা যাইবো ততক্ষণ ঠিকাছে। তো পাহাড় মশাই তখনো সেখানে বহাল তবিয়তে। মেঘগুলি পালিয়েছে। পাহাড়ের চুড়ায় বিকালের ঠিকরে পড়া পড়ন্ত রোদ আর পেটভর্তি আব-এ-দিলখুশ্ সব মিলিয়ে এইবার ভাল্লাগা শুরু হলো। পরবর্তী বোতলের জন্য খানিক পাপড় ভাঁজা ছাড়া আর কিছু নাই। নবম বোতল শেষ। এইবার জয় ক্ষ্যামা দিলো পার্বত্য রাজনীতিতে। শুরু হলো গান। নানারকম গান। তাল সে তাল মিলা থেকে শুরু করে বিপিন বাবুর কারন সুধা, এই তো জীবন, মুঝে দুনিয়া ওয়ালো শারাবী না সমঝো, নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে, শিকারী শিকার করে বোতলে মাতাল এইরকম বহুগুচ্ছ সুরসপ্তক। তবে সুপার হিট ছিল প্রাচ্যনাটের
"নিশিথ নিরজনে গুফনে গুফনে
করিবো প্যামের আলাপন
এদেহ যৈবন করিব অর্পন
যদি পাই বন্ধুর দরশন"
(চলবে)
No comments:
Post a Comment