সকাল থেকে আমলাতান্ত্রিক পেজগীতে বসে আছি। ছুটি মিলবে কখন কেউ জানে না। সিরিয়াল ৬১। চলছে ১৭। ১৮ কাগজপত্র গুছিয়ে বসে থাকতে থাকতে নাক ডাকতে শুরু করেছে। বাড়ি ফিলিপিনস। স্বচ্ছ ব্যাগ ফাইল ফুঁড়ে পাসপোর্টের প্রচ্ছদ উঁকি দিচ্ছে। ডান দিকে দেয়াল ঘেঁসে দুই চাঙ্কু কিচিরমিচির করছে। ওদের সিরিয়াল আমার আশে পাশে। নমুনা মোতাবেক আরো অন্তত দুতিন ঘন্টা ভোদাই বসে থাকতে হবে। বাড়ি চলে যাওয়া একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু আগামী তিনদিন শুধু যারা একদেড় হপ্তা আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে তাদের জন্য বরাদ্দ। তার মানে একবারে শুক্রবার। ততদিনে ভিসার মেয়াদ শেষ। হিটলুর দেশে আমলাতন্ত্র ম্যাক্স ভেবারকে ভূলতে পারেনি। সকাল সাড়ে আটটায় অফিস শুরু। আটটায় এসে দেখি লাইন রিসেপশান ডেস্ক থেকে গোটাতিন মোচড় দিয়ে ফেলেছে। লাইনে সামনের দিকে দাঁড়ানো থমাসকে চিনতে পারলাম। নিচের গেট নাকি ভোর ৬টা থেকে খোলা। গোটা কয়েক আরব, আফ্রিকান আর পূর্ব ইউরোপীয় পরিবার একেবারে আন্ডাবাচ্চাসহ সেই ভোর থেকে লাইনে দাঁড়ানো। আফ্রিকান পরিবারটি সম্ভবত তোগো থেকে এসেছে। কোঁকড়া চুলের বছর তিনেকের বাচ্চাটি একটু পর পর প্যারাম্বুলেটর থেকে নেমে কয়েক চক্কর দৌড়ে আবার নিজেই মুখে চুষনি গুঁজে বসে পড়ে। আরো খানিক পেছনে লেবানিজ ভদ্রমহিলা বারে বারে নিরস্ত করা সত্ত্বেও তার কণ্যাটি সুযোগ পাবামাত্র নাকে আঙ্গুল গুঁজে দিচ্ছে। প্রথম কয়েকবার ধমকের পরে স্বর্গীয় হাসি দিয়ে আবার নাকে মন দিলেও পঞ্চম বা ষষ্ঠ ধমকের পরে ঘর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পেছনের সারির বামদিকে বসা রুশ বালিকাগুলি কিচিরমিচির হেসে কি কি যেন বলে। "কেযাভ্কা" শব্দটা বুঝতে পারলাম। লোকায়ত বাংলায় "হিঙ্গৈল"। ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলাম বছর কুড়ি পেছনে। গ্রামের বাড়িতে মেজ চাচার ছেলে পাঁচ বছরের বদু অভিমানে কেঁদে উঠেছিল ডিম পোচ খেতে দেওয়ায়। চাচীকে ডাকছিল ব্যকুল হয়ে। "অ মা ! হিঙ্গৈল দিছে এএএএএএএ...."। মুখগুলি মনে আনতে স্মৃতিতে অনেক ঝাড়ফুঁক করতে হয়। আমরা ক্রমশই চিঠি পাবার লোভে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। মনে পড়েছে.... হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান দেখেছি অনেক। শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শেষ কথা ছিল.....একটা চিঠি থেকে আরেকটা চিঠির দূরত্ব বেড়েছে কেবল....একটা গাছ থেকে আরেকটা গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি কখনো........
সামনের সারিতে মোটামতো এক রুশ মহিলা ব্যাগ থেকে চকলেটের ঠোঙ্গা বের করে মুখে দিতে চোখাচোখি হতে হেসে ফেলেন। একটা নাটওয়ালা বার সাধলেন। আমি ধন্যবাদ দিয়ে ফিরিয়ে দিতে মহিলা প্রায় জোর করে হাতে গুঁজে দিলেন। তারপর কি মনে করে একাকি ভুড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। স্নিগ্ধ হাসি। চকলেট পেয়ে মন্দ হয়নি। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। বালিশ থেকে মাথা তুলেই ফাইল হাতে দৌড় দিয়েছি।
চকলেটের জামা খুলে মনে হলো একটু কফি মন্দ হতো না। ডানদিকের প্যাসেজের মাথায় কফি মেশিন দেখা যাচ্ছে। দুইটা বিশ সেন্ট,একটা দশ সেন্ট আর একটা পাঁচ সেন্টের কয়েন চালান করে দিলাম। নিচে একটা কপাট খুলে প্লাস্টিকের গ্লাস বেরিয়ে পজিশন নিতে ভোঁ করে কফি নেমে এলো। একেবারে মাপমতো। এক ফোঁটাও বেশী না। বেশ লাগছিল হেঁটে হেঁটে একেক চুমুক কফি আর একেক কামড় কোকোর পিঠা। কফি শেষ হতে হতে টের পেলাম পেটে ডিকন্সট্রাকশান শুরু হয়ে গেছে। একটু চেপে থাকতে চেষ্টা করার হথা মনে করতে চোখে অন্ধকার দেখলাম। মনে হলো হাবিয়া দোজখ কড়ি-বরগা শুদ্ধ ভেঙে পড়বে মাথার উপর।
প্রায় মিনিট বিশেক পরে বেশ হালকা লাগলো। বেরিয়ে দেখি বৈদ্যুতিক স্কোরবোর্ডে আলো জ্বলছে ২৮ নম্বরে। টোকেনটা মানিব্যাগে ভরে বেরিয়ে এলাম। বিড়ি খেতে হবে। ইমিগ্রেশান অফিসের ডান পাশে একটা লেবানিজ দোকান। এক প্যাকেট মার্লব্রো নিলাম। ২০ ইউরোর নোট দিলাম। একটা দশ ইউরো একটা পাঁচ ইউরোর নোটের সাথে একটা এক ইউরোর কয়েন ফেরত পেলাম। একটা ম্যাচ পেলাম ফাও। ম্যাচ দিয়ে বিড়ি ধরাতে আলাদা ফিলিংস।
বিড়িতে শেষ টান দিয়ে গণ ছাইদানে গুজে দিলাম। রাস্তায় ফিল্টার ফেলে ধরা খাবার সেলামী ৩০ ইউরো। তিনতলায় উঠলাম। সবমিলিয়ে ৬৬ ধাপ সিঁড়ি। ৩৬ চলছে। গতি খানিক বাড়লো মনে হয়। আনাস্তাশিয়াকে দেখলাম। আট মাসের মতো চলছে মনে হলো। সেদিনো ইউনিভার্সিটির পার্টিতে দেখেছি মরিৎসের সাথে। মরিৎস গোটা তিন কাৎ হলে খানিক ব্যাজার মুখে রাত সাড়ে বারো নাগাদ বাড়ি ফিরেছিল। আমাকে দেখে হাত নাড়লো।
: খবর কী?
: এইতো!
স্ফীতোদরের দিকে ইঙ্গীত করলো।
: মরিৎস আসে নাই?
: না। কাজে গেছে। তোমার আর কতদিন?
: কি জানি. কতদিনের সীল মারে।
: তোমার ধৈর্যও আছে!
আগের সীট দখল হয়ে গেছে। বামদিকের কোনায় জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। আনার ধৈর্যে কুলায় নি। মরিৎসের সাথেই গাট্টা বেঁধে ফেলেছে। এখন কাগজ হবার প্রক্রিয়া চলছে। ভালোই আছে।
বছর তিন আগে গালিয়েভা জুলফিয়ার ভিসা রিজেক্ট হয়েছিল অজ্ঞাত কারণে। অনেক কাঁদছিল সেদিন। আন্দ্রে মারুশভ নামের এক রুশ ইমিগ্র্যান্ট বিয়ের প্রতিশ্রুতি শেষ মুহুর্তে রাখেনি। পরের সপ্তাহে দেশে ফিরে গেল। দেশে ফিরতে হয়েছিল বিলিয়ানাকেও। ও অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা দেখাতে পারেনি। কারো কাছ থেকে ধার নিতে পারতো। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়ামি করে বাড়ি ফিরে গেল। যারা বাড়ি ফিরে গেল তারা কেমন আছে? হয়তো ভালো আছে। জুলফিয়া বিয়ে করেছে শুনেছি। বিলি ফ্যাশান ডিজাইনিং শিখছে। আর আমরা যারা ভিসা পেলাম তারা ঝুলে থাকলাম সেমিস্টার থেকে সেমিস্টারের রোপওয়েতে।
৪৯ নম্বরে বাতি জ্বলছে। মাথায় স্কার্ফ পড়া মোটামতো তুর্কি খালাম্মা নাক ডাকছেন। আরেকটা বিড়ি খেয়ে আসি। বেলা পৌনে এগারোটা। রোদের জ্যামিতি প্যাসেজের মাঝামাঝি। ৬৬ ধাপ হুড়মুড় করে নেমে গেলাম। একটু ধীরে হলেও চলতো। সময় খরচটা এখন জরুরি।
ইমিগ্রেশান অফিসের উল্টোদিকে ট্রামস্টেশান পেরিয়ে একদিকে খেলনার দোকান, ফটোকপির দোকান, ছবি তোলার দোকান পাশাপাশি, আরেক দিকে কিছু ঘরবাড়ি। ওখানকার কোন একটা অ্যাপার্টমেন্টে জগন্নাথন বাবু থাকেন। তাঁর বারে কাজ করেছি কিছুদিন। শ্রীলঙ্কার মানুষরা স্পষ্টভাষী। শুরুতেই পরিস্কার বলে দিয়েছিলেন, দেখেন ভাই আমার দোকানে বিক্রিবাট্টা কম, মাইরা কাইটা ঘন্টায় পাঁচ ইউরোর বেশী দিতে পারুম না। একমাসের মাথায় সেই বার বিক্রি হয়ে গেলে ভদ্রলোক তিনকিস্তিতে আমার পাওনা মিটিয়ে দেন। বার্গার কিং এ এক শুক্রবার সারারাত কাজ করেছিলাম। মরক্কোর সফেদ চিফ সারাটা সময় খ্যাক খ্যাক করছিলেন। পরে ওখানে কাজও হয়নি, একটা পাই পয়সাও পাইনি। নালিশ নিয়ে এসেছিলাম এমপ্লয়মেন্ট অফিসে। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি যে ঐখানে কাজ করছো সেইটা প্রমাণ করতে পারবা? পারবো না। আর যাইনি। ম্যাগডোনাল্ডস-বার্গার কিং পর্বের ঐখানেই ইতি।
শেষ টানে ফিল্টারের খানিকটা পুড়ল। ওপরে আর যেতে ইচ্ছা করছে না। অথচ আজকে এক্সটেইন না করলে ঝামেলায় পড়বো। কালরাতে এ্যাতো প্ল্যান করে দশটায় শুয়ে পড়লাম, একটার আগে চোখ বুজলো না।
আবার ৬৬ ধাপ ভেঙে তিনতলায়। ৫২ চলছে। একটা চীনা জুটি ঝগড়া করছে। ফাইল নেড়ে নেড়ে কিচিরমিচির। মেয়েটা বোধহয় পাসপোর্ট বাসায় ফেলে এসেছে। একটু পরে ধুপধাপ করে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল। সামনের সারির আফ্রিকান মহিলাটি জানতে চাইলেন আমার নম্বর কতো। তিনি ৫৮।
সিড়িতে ধুপধাপ শব্দ। গোটাতিন প্রমাণাকৃতি পুলিশ সোজা ঢুকে গেল ১১২ নম্বরে। একটা বিশালদেহী কালো মানুষকে তিনজনে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন। সে কৈ মাছের মতো ছটফট করছিল। আই ওন্ত গো...আই ওন্ত গো...ইউ কেন্ত দু দিস তু মি...। অপেক্ষমাণদের মধ্যে খানিক গুঞ্জন। ভদ্রলোকের জার্মান স্ত্রী নাকি দুবছরের মাথায় তালাক ঠুকেছেন। কাগজ পেতে কমপক্ষে তিনবছর টানটান বনিবনা রাখতে হয়। সবচাইতে নিরাপদ নাকি তিনবছরে তিনপিস। রহিমকরিমসেলিম।
১১২ থেকে ফ্রাউ ভাইস বেরিয়ে এসে বললেন, লীগ্যাল কাগজপত্র না দেখাতে পারলে আমরা পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো। বামদিকের দেয়ালে যে তালিকা আছে সেটা আগে দেখে নিন। সবাই ফাইলটাইল খুলে কাগজ গুণে দেখা শুরু করেছে। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পরে কি মনে করে ফাইল খুলে দেখা শুরু করলাম। পাসপোর্ট, ইউনিভার্সিটির আইডি, হেলথ ইনসুরেন্স, ব্যাঙ্ক......থুক্কু..! ব্যাঙ্কের কাগজ কই? আগাপাশতলা করে মনে হলো হায় হায় আমি তো ঘুম থেকে উঠে সোজা চলে এলাম! ব্যাঙ্কে তো যাওয়া হয় নি। ওদিকে ৫৬ নম্বর ঢুকে পড়লো।
৬৬ ধাপের গোটা তিরিশে পা দিয়ে দৌড়ে দেখি ট্রাম আসছে। একেবারে ড্রাইভারের পেছনের সীটে বসে পড়লাম। স্টেয়ার্নের মোড়ে সিগন্যাল। একমিনিটদুমিনিটতিনমিনিট। আবার ছাড়লো ট্রাম। ক্যোয়নিগস্ প্লাৎসে নেমে সোজা ব্যাঙ্কের ডকুমেন্টস বের করার যন্ত্রের সামনে। কার্ড ঠেলে দিয়ে টিপ দিলাম জাগামতো। খুব ধীরে ধীরে বের হলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনপাতার স্টেটমেন্ট। যাক ঠিক আছে। গতরাতে টোকন ভাইকে ট্রান্সফার করা ১০০০ ইউরোর সংবাদ এখনো মেশিনে পৌছেনি। এলেই ব্যালেন্স অর্ধেক হয়ে যেত।
কোনরকম ব্যাগে গুজে দৌড়। ট্রাম আসছে না। মাটিতে জুতা ঘসি। থুতু ফেলি বার তিনেক। তিনবারের বার টের পাই থুতু আসছে না। শুকনো লাগছে। কোন শালা জানি পকেট রেডিও নিয়ে ঘুরছে। স্কাাাাইইই্ই রেডিওওওওও। বারোটা কুড়ি। ইমিগ্রেশান অফিস সাড়ে বারোটায় বন্ধ হবে। ট্রাম এতো ধীরে আসছে কেন? মাঝের সারিতে একটা প্যারাম্বুলেটরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। আবার স্টেয়ার্নের মোড়ে বোকাচোদা সিগন্যাল। ধুপধাপ করে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে দাঁড়ালাম। আলেস ক্লার?(সব ঠিকাছে?)। হাসির চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি মুখ বাঁকা হচ্ছে না। ঘড়ির দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছি না। ট্রাম থেকে নেমে দৌড়। সিগন্যালে লাল না সবুজ দেখার সময় ছিল না। ধরা পড়লে চল্লিশ ইউরো গুনতে হতো। সিড়ি পর্যন্ত পৌছবার আগে ধুম্ করে বাড়িখেলাম দরজার পাল্লায়। ৬৬ ধাপের ২০ টার বেশী মনে হয় এই দফা ছুঁইনি। ওয়েটিং রূম খালি প্রায়। মরতে মরতে গিয়ে ১১২ তে নক করলাম।
: মোমেন্ট!
ফ্রাউ ভাইস দরজা খুললেন।
: অফিস তো এখনি বন্ধ হবে। আপনি শুক্রবার আসেন।
: আমার ভিসা কালকে শেষ।
ভেতরে গিয়ে বসলাম।
: মাথা ফাটলো কিভাবে?
: কোথায়?
: মাথা আবার কোথায় থাকে?
তুলার মাথায় একটু অ্যান্টি সেপটিক মাখিয়ে দিয়ে কপালের ক্ষতটা মুছে দিলেন। তারপর আমার ফাইল খুলে সোজা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বললেন, কালকে কোথায় ভিসা তো শনিবার পর্যন্ত! তারপর আইডিটা দেখতে দেখতে বললেন, আর কতদিন লাগবে শেষ হতে। বললাম, থিসিসটিসিস মিলিয়ে আরো বছর দেড়েক। হুম। পয়তাল্লিশ ইউরোর একটা টোকেন নিয়ে আসেন। দৌড়ে বের আবারো ধাক্কা খেলাম। এবার ভিকটিম তুর্কি খালাম্মা। ভদ্রমহিলা ব্যাথা পাওয়া দূরে থাক ভুড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। দুটো কুড়ি ইউরো আর একটা পাঁচ ইউরোর নোট সুড়ুৎ করে খেয়ে ফেললো মেশিন। তারপর সাইরেন বাজিয়ে বের হলো দুই টুকরা টোকেন।
একটা টোকেন আমার ফাইলে ভরে দিয়ে আরেকটা খাইয়ে দিলেন পাশের কোন এক যন্ত্রকে। চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে একটা ব্যান্ড এইড দিয়ে বললেন কপালে লাগিয়ে নিতে বাইরে অনেক ধূলা।
ট্রামে উঠে শরির ছেড়ে দিলাম। পাসপোর্ট খুলে দেখি আরো দুবছর আরো কিছু নতুন নাটকের সুলুক।
সামনের সারিতে মোটামতো এক রুশ মহিলা ব্যাগ থেকে চকলেটের ঠোঙ্গা বের করে মুখে দিতে চোখাচোখি হতে হেসে ফেলেন। একটা নাটওয়ালা বার সাধলেন। আমি ধন্যবাদ দিয়ে ফিরিয়ে দিতে মহিলা প্রায় জোর করে হাতে গুঁজে দিলেন। তারপর কি মনে করে একাকি ভুড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। স্নিগ্ধ হাসি। চকলেট পেয়ে মন্দ হয়নি। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। বালিশ থেকে মাথা তুলেই ফাইল হাতে দৌড় দিয়েছি।
চকলেটের জামা খুলে মনে হলো একটু কফি মন্দ হতো না। ডানদিকের প্যাসেজের মাথায় কফি মেশিন দেখা যাচ্ছে। দুইটা বিশ সেন্ট,একটা দশ সেন্ট আর একটা পাঁচ সেন্টের কয়েন চালান করে দিলাম। নিচে একটা কপাট খুলে প্লাস্টিকের গ্লাস বেরিয়ে পজিশন নিতে ভোঁ করে কফি নেমে এলো। একেবারে মাপমতো। এক ফোঁটাও বেশী না। বেশ লাগছিল হেঁটে হেঁটে একেক চুমুক কফি আর একেক কামড় কোকোর পিঠা। কফি শেষ হতে হতে টের পেলাম পেটে ডিকন্সট্রাকশান শুরু হয়ে গেছে। একটু চেপে থাকতে চেষ্টা করার হথা মনে করতে চোখে অন্ধকার দেখলাম। মনে হলো হাবিয়া দোজখ কড়ি-বরগা শুদ্ধ ভেঙে পড়বে মাথার উপর।
প্রায় মিনিট বিশেক পরে বেশ হালকা লাগলো। বেরিয়ে দেখি বৈদ্যুতিক স্কোরবোর্ডে আলো জ্বলছে ২৮ নম্বরে। টোকেনটা মানিব্যাগে ভরে বেরিয়ে এলাম। বিড়ি খেতে হবে। ইমিগ্রেশান অফিসের ডান পাশে একটা লেবানিজ দোকান। এক প্যাকেট মার্লব্রো নিলাম। ২০ ইউরোর নোট দিলাম। একটা দশ ইউরো একটা পাঁচ ইউরোর নোটের সাথে একটা এক ইউরোর কয়েন ফেরত পেলাম। একটা ম্যাচ পেলাম ফাও। ম্যাচ দিয়ে বিড়ি ধরাতে আলাদা ফিলিংস।
বিড়িতে শেষ টান দিয়ে গণ ছাইদানে গুজে দিলাম। রাস্তায় ফিল্টার ফেলে ধরা খাবার সেলামী ৩০ ইউরো। তিনতলায় উঠলাম। সবমিলিয়ে ৬৬ ধাপ সিঁড়ি। ৩৬ চলছে। গতি খানিক বাড়লো মনে হয়। আনাস্তাশিয়াকে দেখলাম। আট মাসের মতো চলছে মনে হলো। সেদিনো ইউনিভার্সিটির পার্টিতে দেখেছি মরিৎসের সাথে। মরিৎস গোটা তিন কাৎ হলে খানিক ব্যাজার মুখে রাত সাড়ে বারো নাগাদ বাড়ি ফিরেছিল। আমাকে দেখে হাত নাড়লো।
: খবর কী?
: এইতো!
স্ফীতোদরের দিকে ইঙ্গীত করলো।
: মরিৎস আসে নাই?
: না। কাজে গেছে। তোমার আর কতদিন?
: কি জানি. কতদিনের সীল মারে।
: তোমার ধৈর্যও আছে!
আগের সীট দখল হয়ে গেছে। বামদিকের কোনায় জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। আনার ধৈর্যে কুলায় নি। মরিৎসের সাথেই গাট্টা বেঁধে ফেলেছে। এখন কাগজ হবার প্রক্রিয়া চলছে। ভালোই আছে।
বছর তিন আগে গালিয়েভা জুলফিয়ার ভিসা রিজেক্ট হয়েছিল অজ্ঞাত কারণে। অনেক কাঁদছিল সেদিন। আন্দ্রে মারুশভ নামের এক রুশ ইমিগ্র্যান্ট বিয়ের প্রতিশ্রুতি শেষ মুহুর্তে রাখেনি। পরের সপ্তাহে দেশে ফিরে গেল। দেশে ফিরতে হয়েছিল বিলিয়ানাকেও। ও অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা দেখাতে পারেনি। কারো কাছ থেকে ধার নিতে পারতো। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়ামি করে বাড়ি ফিরে গেল। যারা বাড়ি ফিরে গেল তারা কেমন আছে? হয়তো ভালো আছে। জুলফিয়া বিয়ে করেছে শুনেছি। বিলি ফ্যাশান ডিজাইনিং শিখছে। আর আমরা যারা ভিসা পেলাম তারা ঝুলে থাকলাম সেমিস্টার থেকে সেমিস্টারের রোপওয়েতে।
৪৯ নম্বরে বাতি জ্বলছে। মাথায় স্কার্ফ পড়া মোটামতো তুর্কি খালাম্মা নাক ডাকছেন। আরেকটা বিড়ি খেয়ে আসি। বেলা পৌনে এগারোটা। রোদের জ্যামিতি প্যাসেজের মাঝামাঝি। ৬৬ ধাপ হুড়মুড় করে নেমে গেলাম। একটু ধীরে হলেও চলতো। সময় খরচটা এখন জরুরি।
ইমিগ্রেশান অফিসের উল্টোদিকে ট্রামস্টেশান পেরিয়ে একদিকে খেলনার দোকান, ফটোকপির দোকান, ছবি তোলার দোকান পাশাপাশি, আরেক দিকে কিছু ঘরবাড়ি। ওখানকার কোন একটা অ্যাপার্টমেন্টে জগন্নাথন বাবু থাকেন। তাঁর বারে কাজ করেছি কিছুদিন। শ্রীলঙ্কার মানুষরা স্পষ্টভাষী। শুরুতেই পরিস্কার বলে দিয়েছিলেন, দেখেন ভাই আমার দোকানে বিক্রিবাট্টা কম, মাইরা কাইটা ঘন্টায় পাঁচ ইউরোর বেশী দিতে পারুম না। একমাসের মাথায় সেই বার বিক্রি হয়ে গেলে ভদ্রলোক তিনকিস্তিতে আমার পাওনা মিটিয়ে দেন। বার্গার কিং এ এক শুক্রবার সারারাত কাজ করেছিলাম। মরক্কোর সফেদ চিফ সারাটা সময় খ্যাক খ্যাক করছিলেন। পরে ওখানে কাজও হয়নি, একটা পাই পয়সাও পাইনি। নালিশ নিয়ে এসেছিলাম এমপ্লয়মেন্ট অফিসে। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি যে ঐখানে কাজ করছো সেইটা প্রমাণ করতে পারবা? পারবো না। আর যাইনি। ম্যাগডোনাল্ডস-বার্গার কিং পর্বের ঐখানেই ইতি।
শেষ টানে ফিল্টারের খানিকটা পুড়ল। ওপরে আর যেতে ইচ্ছা করছে না। অথচ আজকে এক্সটেইন না করলে ঝামেলায় পড়বো। কালরাতে এ্যাতো প্ল্যান করে দশটায় শুয়ে পড়লাম, একটার আগে চোখ বুজলো না।
আবার ৬৬ ধাপ ভেঙে তিনতলায়। ৫২ চলছে। একটা চীনা জুটি ঝগড়া করছে। ফাইল নেড়ে নেড়ে কিচিরমিচির। মেয়েটা বোধহয় পাসপোর্ট বাসায় ফেলে এসেছে। একটু পরে ধুপধাপ করে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল। সামনের সারির আফ্রিকান মহিলাটি জানতে চাইলেন আমার নম্বর কতো। তিনি ৫৮।
সিড়িতে ধুপধাপ শব্দ। গোটাতিন প্রমাণাকৃতি পুলিশ সোজা ঢুকে গেল ১১২ নম্বরে। একটা বিশালদেহী কালো মানুষকে তিনজনে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন। সে কৈ মাছের মতো ছটফট করছিল। আই ওন্ত গো...আই ওন্ত গো...ইউ কেন্ত দু দিস তু মি...। অপেক্ষমাণদের মধ্যে খানিক গুঞ্জন। ভদ্রলোকের জার্মান স্ত্রী নাকি দুবছরের মাথায় তালাক ঠুকেছেন। কাগজ পেতে কমপক্ষে তিনবছর টানটান বনিবনা রাখতে হয়। সবচাইতে নিরাপদ নাকি তিনবছরে তিনপিস। রহিমকরিমসেলিম।
১১২ থেকে ফ্রাউ ভাইস বেরিয়ে এসে বললেন, লীগ্যাল কাগজপত্র না দেখাতে পারলে আমরা পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো। বামদিকের দেয়ালে যে তালিকা আছে সেটা আগে দেখে নিন। সবাই ফাইলটাইল খুলে কাগজ গুণে দেখা শুরু করেছে। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পরে কি মনে করে ফাইল খুলে দেখা শুরু করলাম। পাসপোর্ট, ইউনিভার্সিটির আইডি, হেলথ ইনসুরেন্স, ব্যাঙ্ক......থুক্কু..! ব্যাঙ্কের কাগজ কই? আগাপাশতলা করে মনে হলো হায় হায় আমি তো ঘুম থেকে উঠে সোজা চলে এলাম! ব্যাঙ্কে তো যাওয়া হয় নি। ওদিকে ৫৬ নম্বর ঢুকে পড়লো।
৬৬ ধাপের গোটা তিরিশে পা দিয়ে দৌড়ে দেখি ট্রাম আসছে। একেবারে ড্রাইভারের পেছনের সীটে বসে পড়লাম। স্টেয়ার্নের মোড়ে সিগন্যাল। একমিনিটদুমিনিটতিনমিনিট। আবার ছাড়লো ট্রাম। ক্যোয়নিগস্ প্লাৎসে নেমে সোজা ব্যাঙ্কের ডকুমেন্টস বের করার যন্ত্রের সামনে। কার্ড ঠেলে দিয়ে টিপ দিলাম জাগামতো। খুব ধীরে ধীরে বের হলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনপাতার স্টেটমেন্ট। যাক ঠিক আছে। গতরাতে টোকন ভাইকে ট্রান্সফার করা ১০০০ ইউরোর সংবাদ এখনো মেশিনে পৌছেনি। এলেই ব্যালেন্স অর্ধেক হয়ে যেত।
কোনরকম ব্যাগে গুজে দৌড়। ট্রাম আসছে না। মাটিতে জুতা ঘসি। থুতু ফেলি বার তিনেক। তিনবারের বার টের পাই থুতু আসছে না। শুকনো লাগছে। কোন শালা জানি পকেট রেডিও নিয়ে ঘুরছে। স্কাাাাইইই্ই রেডিওওওওও। বারোটা কুড়ি। ইমিগ্রেশান অফিস সাড়ে বারোটায় বন্ধ হবে। ট্রাম এতো ধীরে আসছে কেন? মাঝের সারিতে একটা প্যারাম্বুলেটরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। আবার স্টেয়ার্নের মোড়ে বোকাচোদা সিগন্যাল। ধুপধাপ করে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে দাঁড়ালাম। আলেস ক্লার?(সব ঠিকাছে?)। হাসির চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি মুখ বাঁকা হচ্ছে না। ঘড়ির দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছি না। ট্রাম থেকে নেমে দৌড়। সিগন্যালে লাল না সবুজ দেখার সময় ছিল না। ধরা পড়লে চল্লিশ ইউরো গুনতে হতো। সিড়ি পর্যন্ত পৌছবার আগে ধুম্ করে বাড়িখেলাম দরজার পাল্লায়। ৬৬ ধাপের ২০ টার বেশী মনে হয় এই দফা ছুঁইনি। ওয়েটিং রূম খালি প্রায়। মরতে মরতে গিয়ে ১১২ তে নক করলাম।
: মোমেন্ট!
ফ্রাউ ভাইস দরজা খুললেন।
: অফিস তো এখনি বন্ধ হবে। আপনি শুক্রবার আসেন।
: আমার ভিসা কালকে শেষ।
ভেতরে গিয়ে বসলাম।
: মাথা ফাটলো কিভাবে?
: কোথায়?
: মাথা আবার কোথায় থাকে?
তুলার মাথায় একটু অ্যান্টি সেপটিক মাখিয়ে দিয়ে কপালের ক্ষতটা মুছে দিলেন। তারপর আমার ফাইল খুলে সোজা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বললেন, কালকে কোথায় ভিসা তো শনিবার পর্যন্ত! তারপর আইডিটা দেখতে দেখতে বললেন, আর কতদিন লাগবে শেষ হতে। বললাম, থিসিসটিসিস মিলিয়ে আরো বছর দেড়েক। হুম। পয়তাল্লিশ ইউরোর একটা টোকেন নিয়ে আসেন। দৌড়ে বের আবারো ধাক্কা খেলাম। এবার ভিকটিম তুর্কি খালাম্মা। ভদ্রমহিলা ব্যাথা পাওয়া দূরে থাক ভুড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। দুটো কুড়ি ইউরো আর একটা পাঁচ ইউরোর নোট সুড়ুৎ করে খেয়ে ফেললো মেশিন। তারপর সাইরেন বাজিয়ে বের হলো দুই টুকরা টোকেন।
একটা টোকেন আমার ফাইলে ভরে দিয়ে আরেকটা খাইয়ে দিলেন পাশের কোন এক যন্ত্রকে। চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে একটা ব্যান্ড এইড দিয়ে বললেন কপালে লাগিয়ে নিতে বাইরে অনেক ধূলা।
ট্রামে উঠে শরির ছেড়ে দিলাম। পাসপোর্ট খুলে দেখি আরো দুবছর আরো কিছু নতুন নাটকের সুলুক।
No comments:
Post a Comment